ছোটবেলা থেকেই ঠিক আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো ছিলেন না ‘শিল্পী’। গেছো মেয়ে বলতে যা বোঝায়, অনেকটা যেন তাই। সাইকেল নিয়ে দাবড়ে বেড়াতেন। এর পাশাপাশি নাচ শিখতেন। জীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাতের পরেও নাচ ছাড়েননি। নাচের পেছনে সেই নিষ্ঠাই তাঁকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক ড্যান্স কাউন্সিলের সদস্য হয়েছেন নওগাঁর নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক মোরশেদা বেগম। যিনি শিল্পী নামে সমধিক পরিচিত। একই মর্যাদা পেয়েছে মোরশেদার নাচের প্রতিষ্ঠান নৃত্য নিকেতন।
এই স্বীকৃতির ফলে এখন থেকে ইউনেসকোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন তিনি ও তাঁর দল। শুধু তা-ই নয়, দেশে আন্তর্জাতিক মানের যেকোনো নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনেও সহায়তা করবে ইউনেসকো। ইতিমধ্যে তারা ন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিল থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পেয়েছে। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের সাধারণ সভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন মোরশেদা এবং তাঁর দল।
আগামী ৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে ২৩তম এই সভা। নৃত্য বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজন। তবে এখনো যাওয়া নিশ্চিত করতে পারেননি। দলবল এমনকি একাও সেখানে যাওয়ার সংগতি নেই। সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এ জন্য আবেদনও করেছেন।
মোরশেদা বেগম নওগাঁতেই থাকেন। নওগাঁ ডিসি অফিসে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োজিত তিনি। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলে অংশ নিতে ফ্রান্সে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। সেগুনবাগিচার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। সে সময় মোরশেদা বেগম জানান, শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনো তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কেননা এ সভায় অংশ নেওয়ার জন্য শুধু সেখানকার থাকা, খাওয়া এবং স্থানীয় যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হবে ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিল থেকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের বেশির ভাগ সদস্যের পাসপোর্ট নেই। ফ্রান্সে যাওয়া–আসা করার সংগতি নেই।’
ইউনেসকোর স্বীকৃতি সম্পর্কে ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় নৃত্যে রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া মোরশেদা বেগম বললেন, ‘আমরা কোনো রকম যোগাযোগ করিনি কিংবা কোনো ধরনের আবেদনের বিষয় ছিল না। আগস্ট মাসের ৭ তারিখে প্রথম ইউনেসকোর সদর দপ্তর থেকে আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে। ইউনেসকোর ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের পক্ষে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের অ্যালকিস রাফটিস সরাসরি যোগাযোগ করেন। সে সময় অ্যালকিস রাফটিস জানতে চান, “আমাদের যদি বিদেশে নাচ পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে আমরা যাব কি না?” আমরা যেতে রাজি হলে, তিনি আমাদের সংগঠনের এবং আমার বিস্তারিত তথ্য জানতে চান। সেসব পাঠানোর পর তাঁরা ফোনে যোগাযোগ করেন। গত ৩০ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটায় তাঁরা আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, আমি এবং নৃত্য নিকেতনকে এই আন্তর্জাতিক ড্যান্স কাউন্সিলের সদস্য করা হয়েছে।’
ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে মোরশেদা বেগম এবং নৃত্য নিকেতনের তালিকা দেখা যায়। বাংলাদেশের আরও দুজন এ সদস্য পদ লাভ করেছেন, তাঁরা হলেন ঢাকার তুরঙ্গমী স্কুল অব ড্যান্স এর পূজা সেনগুপ্তা ও নৃত্যশিল্পী শর্মিষ্ঠা সোনালিকা সরকার।
১৯৯৭ সালে মোরশেদা বেগম নৃত্য নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ছিল নাচ শেখানোর বিদ্যালয়। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাছাই করা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাচের দল চালু করেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার জাতীয় পর্যায়ের গুরু—যেমন: সাজু আহমেদ, দীপা খন্দকার, বেলায়েত হোসেন খান, শিবলী মহম্মদ। তবে কখনোই ঢাকামুখী সংগঠন গড়তে চাইনি। নওগাঁ শহরকে নিজের ঘাঁটি রেখে সারা দেশে নৃত্য প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি।’ নওগাঁয় থেকেও চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা নৃত্যনাট্য মতো ব্যয়বহুল প্রযোজনা পরিবেশন করেছেন মোরশেদা। করছেন প্রকৃতি, সামাজিক বনায়ন, বর্ষা প্রভৃতি নৃত্যনাট্য।
নৃত্য নিকেতন জাতীয় স্বীকৃতিও কম না। জাতীয় মৌসুমি প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক নৃত্য বিভাগে পরপর সাতবার বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকসহ ‘বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা’ আয়োজিত নৃত্য প্রতিযোগিতায় নৃত্য নিকেতন লোকনৃত্য (দলীয়) প্রথম হয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন