পূর্ব দিগন্তে সবেমাত্র সূর্য ওঠেছে,জানালার কপাটের ফাকা দিয়ে সূর্যের কিরণ গালে এসে পড়লো,যেন মনে হলো মা তার মমতাময়ী হাত দিয়ে গালে স্পর্শ করে বললো;বাবা সকাল হয়ে গেছে, ঘুম থেকে ওঠো।তারপর কিছুক্ষন মোড়ামুড়ি করে ওঠে পড়লাম।মাতালের মতো দুলতে দুলতে চোখ রগরাইতে রগরাইতে উঠানের এক কোনে টিউবয়েলের কাছে গিয়ে নিমের মাজন দিয়ে দাত মাজাঘষা করলাম,এরপর যখন দুহাত দিয়ে তালুভরে পানি নিয়ে মুখে মারবো, ঠিক তখনি বেসুরো গলায় বকাবকির ঝংকার শুনতে পেলাম।ওই বানদির বাচ্চা,কুত্তার বাচ্চা, তোরে আজ জানে মেরে ফেলবো,অহরহ চলমান।আশা করেছিলাম সকালে দোয়েলের ডাক শুনবো,তার পরিবর্তীতে শুনতে হলো তবলা,গিটার, হারমোনির তাল লয় বিহীন শব্দ। যাইহোক, তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, কয়েক বাড়ি পরে সালামত মিয়ার বাড়ির উঠানে গিয়ে দাড়ালাম।ওমা,একি উঠান ভরা মানুষ, সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে কাউকে যেন ঘিরে ধরেছে,মনে হলো সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে।যদি সাপুড়ে সাপের খেলায় দেখায়,তাহলে তো বীনবাঁশির শব্দ আসবে,কিন্তু আসছে অন্যরকম কান্না,গোংগানির শব্দ আর ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারার শব্দ। নাহ্ আর ধৈর্য্য রাখতে পারলাম না।তাড়াতাড়ি মানুষের চিপার মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করলাম।ওহ্! অনেক কষ্টে যেন বর্ডার ক্রস করলাম,কিন্তু বর্ডার ক্রস করার পর একি দেখলাম!
আমাকে আর মারবেন না,আর সহ্য করতে পারছি না,আমি আর জীবনে চুরি করবো না,আমার মা বাবার কসম খেয়ে বলছি ইত্যাদি।কিন্তু প্রতিউত্তরে পিঠে পড়্ছে লাঠির আগাত,বুকে পড়্ছে লাথি আর মুখে পড়্ছে থু থু। চুপ চোরের বাচ্চা চোর,তুই আমার মেয়ের সোনার হার চুরি করেছিস,আজ তোর হাড্ডি জল করে ফেলবো,বলতে না বলতে আবার লাথি।এরপর আর না সইতে পেরে বললাম;চাচা থামুন আর ওকে মারবেন না,ও তো মরে যাবে,এভাবে কি কেউ মারে নাকি?তখন আমার চাচামহাশয় বললো;বাবা তুমি থামো।ওরে জন্মেরমত শিক্ষা দিয়ে দিব, যাতে ওর চুরি বিদ্যার সাধ মিটে যায়, বলতে বলতে আর একবার লাঠি উঁচু করে তুললেন, এই মারবে,অমনি গিয়ে লাঠি ধরে ফেললাম,চাচা আপনার হাতে ধরি আর মারবেন না,দেখুন ওকে মারতে গিয়ে আপনার গেঞ্জি ঘামে ভিজে গেছে।এখন কিছুক্ষন বিশ্রাম নিন।হ্যা,ঠিক বলেছিস,দাড়া একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই। ওই প্রীতি মা, আমারে এক গ্লাস পানি দিয়ে যা। আসছি বাবা...।
চারপাশে কোলাহল,মধ্যখানে হাহাজারি।এর মধ্যেই হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে অতি সন্তর্পণে বলতে লাগলো এই, এই একটু জায়গা দিন,হাতে পানি, পড়ে যাবে কিন্তু। কিন্তু, আহা! কি মধুর কিন্তু।মনে মনে আওরাতে লাগলাম "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিধিশার নিশা/মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য "।
ওহ! এনেছিস মা,দে পানি দে,এই জানোয়ারটাকে পিটাতে পিটাতে হাপিয়ে গেছি।একি! মা তোর চোখে পানি কেন?দাড়া, ওকে আবারো মারছি,তোর হার বলে কথা! দাড়া।মেয়েটি তো দাড়ালো না বরং মুখে আচল চেপে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো।
অদ্ভুত ব্যাপার তো! তার কান্না দেখে আমারও চোখ ছলছল করে উঠলো।আমিও আর ঐখানে দাড়াতে পারলাম না।তৎক্ষনাৎ প্রীতির পেছনে ছুটলাম।প্রীতির ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলাম, প্রীতি একটু শোন,একটু বের হও।পাঁচ মিনিট পরে প্রীতি বের হয়ে আসলো।একি! কান্না,পারে তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।কিন্তু এতো মানুষের সামবে এটি সম্ভব ছিল না।হয়তোবা একলা থাকলে তাই করতো।কারন হাজার হলেও "চিনি তো পানির মধ্যেই গলে"।যাইহোক,সে আমাকে বলতে লাগলো;দেখো, ছেলেটা আমার সবচেয়ে কম দামি হারটি চুরি করেছে,এর জন্য ওকে এতো মারতে হয়! তুমি একটু বাবাকে অনুরোধ করনা,ওকে যেন আর না মারে।আমি বললাম;তোমার মহামান্য পিতা আমার কথায় কান দিচ্ছে না।তুমি যদি সেখানে গিয়ে তোমার বাবাকে অনুরোধ করো,তাহলে উনি হয়তো ওকে আর মারবেনা। আসলে এখানে আমাকে মেয়েজাত সম্পর্কে একটা কথা বলতে হয় "এরা নরম মনের মানুষ,কিন্তু গরম জায়গায় নরমীয়তা দেখাতে সাহস করে না"।তখন বনলতা সেন বললো, তুমি তো ঠিকই বলেছো,আমি যদি গিয়ে বলি, তাহলে বাবা আর মারবেনা।ওহ! কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, এতক্ষনে বুদ্ধির উদয় হলো,মনে মনে আরও বলতে লাগলাম,একে যদি সঙ্গিনি করি,তাহলে আল্লায় ভালো জানে কি হয়! সাথে সাথে মনে পরে গেলো "সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে"।ইনিতো রমনী কিন্তু গুন তো তেমন না।দূর হাজার হলেও আমার বনলতা সেন।
ক্ষানিক পর বাবার একমাত্র কন্যা,দুঃখিত আমার এখনো চাচা।বাবা হয় নি। চাচার সম্মুখে গিয়ে বললো;দেখো বাবা,ছেলেটাকে আর মেরো না,ওতো আমার সামান্য একটা হারই চুরি করেছো।এর চেয়ে কত দামি দামি হার আমি গহনার বাক্সে রেখে দিয়েছি, ঠিকমতো পরিধান করা হয় না।এবারের মতো ছেড়ে দাও।তাছাড়া ছেলেটাকে যে মার মেরেছো,ওর আজম্ন মনে থাকবে।প্লিজ বাবা,এবারের মতো মাফ করে দাও। ওমা! একি বলছিস,ওকে ছেড়ে দিবো! না হয় না কথাটি, প্রীতি আর বলতে না দিয়ে বললো, যদি ওকে আর মার, তাহলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলবো না। আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে মা,আমার কলিজা যেহেতু বলেছে।দিচ্ছি, ওকে ছেড়ে দিচ্ছি। ইস! এতক্ষন আমি না করতে করতে মুখ ব্যাথা করে ফেলেছি।আর এখন মেয়ের কথাতে একেবারে বরফ থেকে পানি! একবার যদি আপনার মেয়েকে সঙ্গিনি করতে পারি,তাহলে নাটক জমবে হবু শ্বশুর মশায়। মনে মনে বলতে লাগলাম।
ওই চোরের বাচ্চা চোর,বানদির পোলা,তোরে এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম। আর যদি কখনো চুরি করিস।তাহলে বলতে বলতে আরও এক লাথি।... জবাই করবো।যাহ্ দূর হ এলাকা থেকে।চোর তো মহাখুশি,যেন জাহান্নাম হতে বিদায় পেলো। আমি কিছুসময় দাড়িয়ে থেকে চোরের পেছনে ছুটলাম।বললাম ওই সানাল ভাই, থামেন একটু থামেন,একটু শুনে যান,আপনাকে মারবো না,দাড়ান। কিন্তু সে কি আর শুনবে আমার কথা।মুহূর্তে উধাও।
আনুমানিক পাঁচদিন পরে একদিন ধান ক্ষেতের আল দিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ সানাল ছেলেটাকে দেখলাম আরেক ধানক্ষেতের আলের মধ্যে বসে সিগারেট টানছে।ও আমাকে খেয়াল করেনি।হয়তোবা খেয়াল করতে পারলে পালিয়ে যেত।তাই আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে ধপ করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।যেই বসলাম,সেই আমাকে দেখে ধরফর করে উঠে যেত লাগলো।তখনি ওর হাত ধরে ফেললাম।বললাম বসেন ভাই,সে এতে ইতস্তত করতে লাগলো।আমি বললাম কোন ভয় নেই।আমি আপনাকে কিছু বলবো না।আচ্ছা, পাঠকগনের সুবিধার্থে ছেলেটার কিছু বর্নণা দিই।ছেলেটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়।দেখতে হ্যাংলা- পাতালা,মুখটা ফ্যাকাশে কিন্তু লম্বায় তালগাছ,শরীরে তেমব শক্তি নেই। তাকে বললাম;দেখেন সানাল ভাই,এভাবে মানুষের জীবন চলে না,আপনি তো এই সমাজেরই একজন মানুষ, আপনি তো সমাজ থেকে আলাদা নন।আপনি এই পেশাটাকে ছেড়ে দেন,দেখবেন একসময় সবাই আপনাকে ভালোবাসবে,সমাজে আপনি অপেক্ষিত হবেন না।আপনারও তো একটা মন আছে আর সেই মনটার কি চায় না সবার মতো আপনিও সমাজে ভালো হয়ে থাকুন? সে কিছু বলছে না।হঠাৎ দেখি তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।তখন আমার দুহাত দিয়ে তার গাল দুটো মুছে দিলাম।সে সাথে সাথে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,ভাই আমার পেট চলে না,আমার একটা বৃদ্ধা মা আছে,মুমূর্ষ অবস্থায় ঘরে পরে আছে। তার ঔষুধ লাগে,কোথাও কাজ করতে গেলে কাজে নেয় না।এখন আমি কী করবো,ভাই?তাই এই পেশা।তখন বললাম,ভাই আপনি এখন সমাজে ভালোভাবে চলতে শুরু করেন,দেখবেন সমাজে একসময় আপনি ভালো মানুষ হয়ে যাবেন,সবাই আপনাকে ভালোবাসবে,আপনাকে কাজে নিবে।তারপর সে কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আমার হাতদুটো তার হাতে নিয়ে বললো,আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি আমি আর চুরি করবো না।
দশদিন পর,
একদিন চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলাম।তখন মতিন মিয়া সালামত মিয়াকে বলতেছিলো;সালামত ভাই, সানাল তো ভালো হয়ে গেছে,সে এখন নামাজ পরে,সবার সাথে ভালো ব্যাবহার করে,সে চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে।তৎক্ষনাৎ সালামত মিয়া মুখটাকে ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো করে গর্জে ওঠলো।বললো;দেখেন মিয়াভাই, "কুত্তার লেজ কখনো সোজা হয় না"।আর আপদের সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি, "অতি ভক্তি চোরের লক্ষ্যন " আর সে তো চোরই।কেউ একে ধারে ঘেষাবেন না,কেউ একে কোনভাবে সাহায্য করবেন না।যদি আমি শুনি কেউ একে সাহায্য করেছেন, তো আমি গ্রামের মাতাব্বর হয়ে সবাইকে বলছি,তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।আপনারা কি চান নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে? সবাই একস্বরে বলে উঠলো না,কখনো না মাতাব্বর সাহেব।আমি জিদের বশে তখন অর্ধেক চা রেখেই চলে আসলাম।উঠে যেতেই মাতাব্বার আমার দিকে বাকা দৃষ্টিতে তাকালো।
একদিন শুক্রবার আমি নামাজ পরে রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম।তখন শুনলাম পেছন থেকে কে যেন ডেকে ওঠলো,রুমান ভাই একটু দাড়ান। আমি তৎক্ষনাৎ দাড়িয়ে গেলাম।জিঙ্গাসা করলাম,তুমি নামাজ পড় নি?সে বললো,নামাজ পড়ে আর কি হবে, মা মারা গেল কদিন হলো,এখন চারদিকে অন্ধকার,আলো চেয়েছিলাম,কিন্তু কালো বিষাক্ত সাপের প্রতিনিয়ত দংশনে মৃত্যুমুখে অতি কষ্টে জীবন নিয়ে দাড়িয়ে আছি।বিশ্বাস করেন আমি ভালো হতে চেয়েছিলাম,আমি ভালো হতে চেয়েছিলাম বলতে বলতে সে চলে গেলো। সানাল ভাই, দাড়ান একটু, দাড়ান...।কিন্তু সে আর শুনলো না।
একমাস পর,সকালবেলা
চৌরাস্তায় দেখি অনেক মানুষ দাড়িয়ে আছে।পা ফেলার জায়গা নেই।সবাই কি যেন অপলক দৃষ্টিতে দেখছে।কী ওখানে?হয়তো নতুন কোন ভদ্র ভিনদেশি মানুষ পথ হারিয়ে বিপদে পরেছে,কারন ভিনদেশি মানুষ দেখলে এদেশের মানুষের উৎসাহের শেষ থাকে না।হয়তো কোন ঔষধ বিক্রেতা,যাদের প্রায় বাজারে কথার ছলে লোক জমাতে দেখা যায়।হয়তো কোন সভা সমাবেশ। হয়তো কোন দুষ্কৃতকারীর বিচার শালীশ।আচ্ছা,কী হতে পারে! আর ভাবতে পারলাম না।অতি কষ্টে মানুষের পর মানুষের ভির ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করলাম।সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তা এই, একটা বর্ধিষ্ণু কড়ই গাছের হালকা মোটা একটা ডালে লম্বা একটা প্রানী ঝুলছে,যার গলায় গরু বাধার রশির একপ্রান্ত ভালো করে আটকানো,অন্য প্রান্ত ঐ ডালটার মধ্যে শক্ত করে বাধা।আর যেটা সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় সেটা হচ্ছে,তার গলায় একটা পোষ্টারের মতো বড় কাগজ ঝুলছে, যার মধ্যে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিলো; আমি অমানুষ ছিলাম,চোর ছিলাম কিন্তু সমাজ কেন ডাকাত?
.
শিক্ষার্থী ঃ
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন