দেশের পুঞ্জীভূত আবর্জনায় দাও আগুন লাগিয়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাম্য ও অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের মূলে কুঠারাঘাত করো। মানুষ মানুষে যে ভেদাভেদ, সমাজের মধ্যে যে পার্থক্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যে শোষণ তা চূর্ণ করো। প্রতিবাদী চেতনার আগুন জ্বালাও। অযোগ্য নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে যোগ্য, কর্মঠ, সাধু ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বিজয় পতাকা উড্ডীন করো। অসন্তোষ ও গস্নানির জীর্ণ পাতা পুড়িয়ে দাও। স্ফুলিঙ্গ ছড়াও, যা দাবানলে পরিণত হবে। সমাজের, ব্যক্তির সর্বপ্রকার ভন্ডামির মুখোশ খুলে ফেলো। এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাও যা শান্তি, সমৃদ্ধি ও হিতের ভূস্বর্গ রচনা করে ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশকে যথার্থই সোনার বাংলায় পরিণত করে তুলবে।
আজ যে সাধারণ মানুষ, চাষি-মজুর খুব কঠিন দুঃসহ জীবনযাপন করছে, তাতে রাষ্ট্র ও সরকারের কিছুই যায়-আসে না। ভাবতে অবাক লাগে, হাজার বছর ধরে বাঙালির অবস্থা এরকমই। চর্যাপদেও পাই এ ধরনের পদ: টিলাতে আমার ঘর, পাড়াপড়শি নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, সারাদিন খিদেয় ধুঁকছি। অন্যত্র : শিশুরা ক্ষুধার্ত, তাদের দেহ কঙ্কালসার, বন্ধু-বান্ধবরা বিমুখ, পুরনো ফুটোফাটা পাত্রে সামান্যই জল ধরে- এসবও আমার তেমন কষ্ট দেয়নি, যেমন কষ্ট দিয়েছিল যখন দেখেছিলাম আমার গৃহিণী ছেঁড়া কাপড় সেলাই করার জন্য রাগী প্রতিবেশিনীর কাছ থেকে সুচ চাইছেন। কিংবা পরনে তার ছেঁড়া কাপড়, বিবর্ণ শীর্ণ দেহ! খিদেয় শিশুদের চোখ গর্তে ঢোকা, পেট-পিঠ এক হয়ে গেছে, তারা খাবে বলে কাঁদছে। দীন-দুস্থ ঘরের বউ চোখের জলে বুক ভাসিয়ে প্রার্থনা করছেন, একমুঠো চালে যেন একশ' দিন চলে। আরেকটি শ্লোক: কাঠের খুঁটি নড়ছে, মাটির দেয়াল গলে পড়ছে, চালের খড় উড়ে যাচ্ছে; কেঁচোর সন্ধানে আসা ব্যাঙেরা আমার ভাঙা ঘর ছেয়ে ফেলেছে।
কবেকার কথা। অথচ এখনো একুশ শতকেও এই ভয়াবহ চিত্র পরিবর্তিত হয়নি। প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অস্বাভাবিক উন্নতি হয়েছে। পাইলট ছাড়াই বিমান বোমা ফাটাচ্ছে। হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। নরনারী ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। কয়েকটি দেশে প্রাচুর্য উপচে পড়ছে। অথচ কয়েকশ' কোটি মানুষ না খেয়ে মরছে, উপোস করছে। জাতিসংঘের সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে। সাধারণ মানুষের জন্য তো নয় জাতিসংঘ।
যাক এসব কথা। দেশের কথা বলি। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসহ দিনগুলো কাটিয়ে গণতন্ত্রের (?) হাওয়ায় এলাম আমরা, তাও প্রায় ১১ বছর অতিবাহিত হয়েছে। দুধের নহর বয়ে যাবে, যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। মাছ-মাংসের দামে আগুন। ফলে শাক-সবজিতেও আগুন। কামলাগিরি করে যারা খান, মুটে-মজুররা, অল্প টাকার মাইনের শ্রমিক; সামান্য বেসরকারি চাকুরে- সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কীভাবে দিন যাবে। এর ওপর প্রকৃতি নিষ্করুণ হলে তাও বুঝেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এখনো তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু নিষ্ঠুর শাসন-শোষণ অব্যাহত রয়েছে। গ্রামে কামলা ও ভূমিহীন চাষির কাজ নেই। দলে দলে মানুষ শহরে আসছে। কাজের খোঁজে। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। কেউ রিকশা টানছে। তারপর গ্রামে কাজ আছে জেনে আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সবাই তো রিকশা টানতে পারে না। তাই চোর-বাটপার-দুর্নীতিবাজরা ভালো আছে। তা সে কোটিপতি শিল্পপতি-ব্যবসায়ী হোক কিংবা আমলা-সংসদ সদস্য-মন্ত্রী হোক। এভাবে ঘুষখোররা ভালো আছে। কারণ এদের কোনো শাস্তি হয় না।
সরকার অহরহ ঢোল পেটাচ্ছে দারিদ্র্য মোচনের। দারিদ্র্য কিন্তু মোচিত হচ্ছে না। হাজার হাজার এনজিও সারাক্ষণ মানুষের মঙ্গলের জন্য জানমাল কোরবানি দিচ্ছে; কিন্তু তাদের উন্নতি হচ্ছে না। যে তিমিরে ছিল তারা, সেই তিমিরেই আছে। কে দেখবে এখন? সরকার। সরকারের কাজ তো অনেক। বড় ও প্রধান কাজ ধনীদের দেখা। তারা কোটিপতি থেকে আরও কোনো পতি যেন হয়। এবার বাজেটেও তার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষের দিকে, গরিবদের দিকে নজর দেয়ার কেউ নেই। অথচ সবই আছে আমাদের। সরকারি প্রচেষ্টায় আন্তরিকতা নেই। তাই এত বেকার। বেকারদের চাকরি নেই। তাই ধান্ধাবাজি। ফলে চোর, ডাকাত বাড়ছে। ছিনতাই, গুম, অপহরণ, হত্যা বাড়ছে। রাজনৈতিক চোর-ডাকাত বাড়ছে। বাড়ছে তাই টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, ভর্তি বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য। এসব সবাই জানে। জানে না কীভাবে প্রতিকার হবে।
দেশের জনসংখ্যা ষোল কোটি। এ বিপুল জনসংখ্যার দেশে খুব কম লোকই আছেন যারা দেশের কথা ভাবেন। এ এক আশ্চর্য দেশ। এমন অবস্থায় শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য বাড়বেই। বাড়ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। ধনী লোক আরও ধনী হচ্ছে। কিসের পরিকল্পনা, কিসের বাজেট, অথচ সরকার দেশের লোকের কথা শোনে না, দৃকপাতও করে না। বিদেশিরা মাঝেমধ্যে এ দেশে এসে সার্টিফিকেট দেয়। আমাদের নেতারা খুব খুশি। আত্মপ্রবঞ্চনার কী অদ্ভুত দৃষ্টান্ত। এটি অন্য কোনো দেশে লক্ষ্য করা যায় না- এমনকি ভুটানের মতো দেশেও নয়।
তাহলে উপায়? নেতা-উপনেতা-পাতিনেতা-কর্মী সবাই নিজের নিজের তালে আছেন। জনগণের সঙ্গে কে থাকবে? দেশের কথা কে ভাববে? জনগণের কথা কে চিন্তা করবে? দেশের শ্রীবৃদ্ধি কে ঘটাবে? দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে কে? সব শ্রেণির মানুষ তো পচে গেছে। গন্ধ বেরুচ্ছে। তাদের দিয়ে তো কিছু হবে না। তাহলে কে আশা দেবে? কে ভরসা দেবে? তরুণসমাজ। তরুণরা-যুবকরা ভরসা দিতে পারে। তাদের বুঝতে হবে, জানতে হবে দেশকে, দেশের মানুষকে। তাহলে তারা শোষণের রূপটি বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন ধন-বৈষম্যের দিকটি। বুঝতে পারবেন কেন মানুষ বিদ্রোহ করছে না। কেন মানুষ ফেটে পড়ছে না। কেন একটি স্ফুলিঙ্গ থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠছে না? কেন কোটি কোটি মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না? কেন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করছে না। নূ্যনতম বাঁচার দাবি কেন পূরণ হবে না? কেন পণ্যমূল্য সহনীয় থাকবে না? কেন থাকবে না বাসস্থান? কেন থাকবে না বস্ত্র? কেন পাবে না শিক্ষা? কেন পাবে না স্বাস্থ্যসেবা?
তরুণদের ভাবতে হবে এসব কথা। তাদের বের করতে হবে পথ। চিহ্নিত করতে হবে কোন পথে মানুষের মুক্তি। তখন তরুণসমাজ দেখবে একনায়কতন্ত্র নয়, স্বৈরতন্ত্র নয়, তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্রই মানুষের মুক্তি আনতে পারে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একাংশ এখনো পচে যায়নি। তারা এখনো টেন্ডারবাজি করে না। তারা এই মাহেন্দ্রক্ষণেও আওয়ামী লীগ সরকারের রমরমা বাণিজ্যকালে বাণিজ্য করে না। তারা ভর্তি ফরম বিক্রি করে না, করে না প্রশ্ন ফাঁস। তারা ছিনতাই করে না। তারা তুরাগ নদী দখল করে না। তারা বুড়িগঙ্গায় অট্টালিকা নির্মাণ করে না। আমরা মনে করি, তারা দেশের কথা ভাবে, দশের কথা ভাবে। রাজনৈতিক দুর্নীতিপ্রবাহে ভেসে যায় না। তাই যদি হয়, অবশ্যই তাদের সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এবং এ পথেই তারা অগ্রসর হবে।
এই সমাজতন্ত্রের পথ কণ্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এটা লক্ষ্য রাখতে হবে তরুণসমাজকে। উপরন্তু তাদের দমন করতে হবে লোভ-লালসা। সতর্ক থাকতে হবে শাসকশ্রেণির ফাঁদ থেকে। তাদের সচেতন থাকতে হবে ইতিহাসের অমোঘ শক্তি সম্পর্কে। তাদের ভরসা করতে হবে সাধারণ মানুষকে- শ্রমিক-কৃষকদের। তরুণরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তারা পারবে বিপস্নব ঘটাতে। শোষণের ইতি ঘটাতে। বৈষম্যের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে। মনে রাখতে হবে, এ এক-দু'দিনের কাজ নয়। দু-চার বছরের কাজ নয়। বিশ-ত্রিশ বছরের কাজ। তাদের শ্রম ও মেধায় জন্ম নেবে সমাজতন্ত্রের উপাসক একটি পার্টি। সেই পার্টি বাংলাদেশের চরিত্র পাল্টে দেবে, স্বভাবের পরিবর্তন ঘটাবে, শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য ঘুচিয়ে দেবে। গণতন্ত্র কী দিয়েছে আমাদের? আমরা জোর গলায় বলি বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, উন্নতি হচ্ছে শনৈঃশনৈ। আসলে কি তাই? সমাজে ধন-বৈষম্য এতটাই প্রকট যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটা হতে পারে না।
তরুণদের মনে রাখতে হবে, গুপ্তবংশ বলুন, পাল বলুন, সেন বলুন, পাঠান বলুন, মোগল বলুন, ইংরেজ বলুন- কোনো সময়ই আমজনতার মঙ্গল হয়নি। ওই যে কবি বলেছেন, হাঁড়িতে চাল নেই, ছেঁড়া শাড়ি, বসতবাড়ি নেই বা ভাঙা- সেই অবস্থা এখনো চলছে। চলতে থাকবে। তাই তরুণদের মাজা খাড়া করে দাঁড়াতে হবে। ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে হবে। সামনের দিকে তাকাতে হবে। মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে। তাদের অবস্থা জানতে হবে। তাদের বুঝতে হবে। মানুষের সঙ্গে একাত্মতা সাধন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এ যাবৎকাল যত রকম 'বাদ'-এর জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে সমাজতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ। এর চেয়ে ভালো 'বাদ' যদি ভবিষ্যতে আসে, তখন তা গ্রহণ করবে মানুষ। কারণ, মানুষের মঙ্গলের জন্যই তো 'বাদ'। অমঙ্গলের জন্য নয়। তাই যত দিন না অন্য কোনো মহৎ 'বাদ'-এর জন্ম হচ্ছে, ততদিন সমাজতন্ত্রই মানুষের মুক্তির শ্রেষ্ঠ 'বাদ'। কারণ, এর মধ্যে মানুষের মুক্তির দিশা আছে। মানুষে মানুষে যে ফারাক আছে, তা ঘুচে যাবে। মানুষে মানুষে যে ধনের পার্থক্য আছে, তা দূর হবে। কারও ধন উপচে পড়বে আর অযুত মানুষ না খেয়ে মরবে, তা হবে না।
তরুণদের প্রতি আমাদের আবেদন, তোমরা জাগো। দেশের পুঞ্জীভূত আবর্জনায় দাও আগুন লাগিয়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাম্য ও অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের মূলে কুঠারাঘাত করো। মানুষ মানুষে যে ভেদাভেদ, সমাজের মধ্যে যে পার্থক্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যে শোষণ তা চূর্ণ করো। প্রতিবাদী চেতনার আগুন জ্বালাও। অযোগ্য নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে যোগ্য, কর্মঠ, সাধু ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের বিজয় পতাকা উড্ডীন করো। অসন্তোষ ও গস্নানির জীর্ণ পাতা পুড়িয়ে দাও। স্ফুলিঙ্গ ছড়াও, যা দাবানলে পরিণত হবে। সমাজের, ব্যক্তির সর্বপ্রকার ভন্ডামির মুখোশ খুলে ফেলো। এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাও যা শান্তি, সমৃদ্ধি ও হিতের ভূস্বর্গ রচনা করে ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশকে যথার্থই সোনার বাংলায় পরিণত করে তুলবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন