করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচতে যে দুটি কাজ সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখমন্ডলে নিজের হাতের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা। একথা ঠিক যে, আমরা নাকে মুখে চোখে সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে হাত দিই। এটা আবার অনেকের বদ অভ্যাস হিসেবেও পরিগণিত। হাত সামলে রাখা যদিও অনেক কঠিন, কিন্তু এই মহামারীকে রুখতে হাতকেও সযতেœ রাখতে হবে, যেনো কোনোভাবেই মুখমন্ডলকে স্পর্শ করতে না পারে।
জানা যায়, আমাদের দেহে ভাইরাসের প্রবেশদ্বার ছয়টি, চোখ, মুখ, কান, নাক, প্রস্রাব ও পায়খানার স্থান। প্রসাব ও পায়খানার স্থান এমনিতে ঢাকা থাকে, সুতরাং ভাইরাস সংক্রমনের সুযোগ একবারেই নাই। কিন্ত অনাবৃত চোখ, মুখ, কান, নাক আমাদের যত ভয়ের কারন। আমরা যদি কমপক্ষে ৩ ফুট শারিরীক দূরত্বে থাকি তাহলে অন্যের কাছ থেকে ভাইরাস সংক্রমনের সুযোগ কম। সেক্ষেত্রে অনাবৃত অংশে নিজের হাতই সর্বনাশ ডেকে আনতে যথেষ্ট। যারা কারণে অকারণে নাক চুলকায়, কান পরিস্কার করে, চোখের ময়লা হাত দিয়ে পরিস্কার করে, আর এই হাতে যদি ভাইরাসটি লুকিয়ে থাকে, তাহলেই সংক্রমিত হবে।
আমেরিকার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ডন মুয়েনি বেকার জানান, শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে এমন ভাইরাসগুলো সাধারণত শরীরের মিউকাসের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। আমাদের নাকে, দাঁতের মাড়িতে আর ঠোঁটে রয়েছে মিউকাস। সংক্রমন থেকে বাঁচার জন্য হাতের পচ্ছিন্নতা তাই এত বেশি জরুরি।
করোনা প্রতিরোধে বলা হচ্ছে, বার বার হাত ধোয়া ও হাত দিয়ে নাক মুখ স্পর্শ না করা। এই কাজটি আমাদের দেশে অনেক কঠিন কাজ হিসেবে বিবেচিত। কারণ এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে খাওয়ার আগে ও পরে, টয়লেট ব্যবহারের আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাসটি পুরোপুরি গড়ে উঠেনি।
করোনা আসার পর একটা বিষয় আমি নিজেই লক্ষ্য করেছি, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কতবার নাক মুখ চোখ স্পর্শ করি। বার বার সতর্ক থাকার পরও হঠাৎই হাত উঠে যায় মুখের দিকে। তারপর সতর্ক হই। এভাবেই আমাদের প্রত্যেককে সতর্ক হতে হবে। সারাদিনে একজন কতবার নিজেদের মুখে হাত স্পর্শ করেন এটির উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। যাদের গবেষনার নমুনা হিসেবে নেয়া হয়, তারা সবাই মেডিকেলের শিক্ষার্থী ছিল। মোট ২৬ জনের উপর পরিচালিত এই গবেষণাটি সচেতন বা অবচেতনে একজন কতবার নিজেদের মুখে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন, সেগুলো ভিডিও ধারণ করেন। দেখা যায়, একজন দৈনিক গড়ে ২৩ বার মুখের ত্বক স্পর্শ করেন। আর অর্ধেকেরও বেশি সময় নাক, চোখ বা ঠোঁটে হাতের স্পর্শ দিয়েছেন এসব শিক্ষার্থী।
সাধারণত নাক মুখে হাত দেয়ার অভ্যাসটা তৈরী হয় ছোটবেলা থেকেই। অনেক সময় আমরা খুব মানসিক চাপে থাকলেও গালে কিংবা মুখে হাত দিয়ে রাখি। এটা অনেকটাই অবচেতন মনে। একবারে কিংবা তাৎক্ষণিক আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে বদলে ফেলতে পারবো, এটা যেমন ঠিক নয়, আবার একটু সতর্কতাই পারে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে।
যেহেতু রাতারাতি এই পুরনো ও দীর্ঘদিন চর্চা করা অভ্যাসটা হুট করেই বদলে ফেলা কঠিন। সেক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। যখন কাশি কিংবা সর্দির ভাব থাকবে তখন সবাই যদি টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করি, টিস্যু বা রুমাল পাশে না থাকলে হাতের কনুইয়ের উপরের অংশ দিয়ে মুখে ছেপে রাখতে হবে। আমরা খাবারের আগে এমনিতেই হাত ধুয়ে থাকি, শুধু পানি দিয়ে না ধুয়ে সাবান দিয়ে ধোয়ার অভ্যাসটা করে ফেলতে হবে। অন্যদিকে টয়লেট ব্যবহারের পরও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার নিয়মটা মেনে চলার অভ্যাস তৈরী করার উপযুক্ত সময় এখনই।
দাঁত দিয়ে হাতের আঙ্গুলের নখ কাটাও অনেকের অভ্যাস বলে পরিগণিত, প্রায়শই এমন দৃশ্য দেখা যায়। তাই হাতের ও পায়ের নখ নিয়মিত কেটে রাখতে হবে, যেন দাঁত দিয়ে নখ কাটার প্রয়োজন না হয়। মনে রাখতে হবে নখের নিচেও ভাইরাস সুপ্ত থাকতে পারে।
এইসময় অনেকেই বাসা থেকে অফিসের কাজ সারছেন। সেক্ষেত্রে কম্পিটার, ট্যাব ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন। প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল ছাড়া অচল, তাই মোবাইল জীবানুমুক্ত রাখতে হবে। অতি প্রয়োজনে যারা বাসার বাইরে যাবে, তাদের হাতের কাজই সবচেয়ে বেশি, টাকা বিনিময়, বাজার করা, বাসার লিফট কিংবা দরজার কড়া নাড়া, সবক্ষেত্রেই হাতকে সংযত রাখতে হবে। বাসার প্রবেশের সময় অন্য কেউ যাতে দরজা খোলে, সে বিষয়ে বাসার সবাইকে আগেই সতর্ক করে দিতে হবে। বাইরে থেকে আসার পরপরই আগে নিশ্চিত পরিস্কার পরিচ্ছন্নত হতে হবে।
একটা অভ্যাস আমাদের মধ্যে লক্ষণীয়, হাত না ধুয়েই আমরা অনেক কিছু খাই। কিংবা অন্যকে খাবার পরিবেশন করি। শুকনা খাবারের বেলায় সাধারণত কেউ হাত ধুয়ে নেয় না। একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, হাত নিয়মিত পরিস্কার রাখলে শুধুই করোনা ভাইরাস নয়, আমাশয়, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জন্ডিস, কৃমি রোগ, চোখ উঠা, ইনফ্লুয়েন্জাসহ নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি ডাক্তাররা অভিমত দেন।
একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, হাত ধোয়ার জন্য আমরা যে কল ব্যবহার করবো এটাও জীবানুমুক্ত করতে হবে। হাত ধোয়ার পর কনুই বা বাম হাত দিয়ে কলটি বন্ধ করা প্রয়োজন। কারন আমরা মুখমন্ডল স্পর্শ করার জন্য সাধারণত ডান হাতকেই ব্যবহার করি।
আসুন সবাই মিলে হাত ধোয়ার সংস্কৃতি চালু করি। সর্বদা হাত পরিস্কার রাখি। এই হাতে যেন আর কোন দুষিত বস্তুর স্পর্শ না লাগে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হাতে যেন কোনো অপবিত্রতার ছোয়া না লাগে। যেকোন অনৈতিক কাজেও যেন আমাদের এই বিশুদ্ধ হাতের স্পর্শ না লাগে। একটি রোগমুক্ত সুন্দর ও কলুষমুক্ত মানুষ হিসেবে এবং একটি সুন্দর দেশ গড়ার নিমিত্তে নিজের হাতকে সর্বদা পরিস্কার রাখি, একটি পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানে সহায়তা করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন