রাফিন মোস্তাফিজের মেয়েটিকে খুব পছন্দ। মেয়েটির নাম অপ্রিয়া মাহফুজ। নাম অপ্রিয় হবার কারণ; সুন্দর বাচ্চাদের যেমন কপালে কালো টিপ দিয়ে মানুষের চোখ থেকে রক্ষা করে তেমনি অপ্রিয়া নামটি দিয়ে ছেলেদের কাছ থেকে দূরে রাখা।
যাহোক, মেয়েটি দুরন্ত মেধাবী। বেশ-ভূষায় সমকালিন, উপস্থিত বুদ্ধিতে অনন্য-সাধারণ। প্রচণ্ড কবিতাপ্রেমি সে। মাঝে মাঝে কবিতাও লিখে। দু’একটি কবিতা পত্রিকা, সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
অবশ্য অপ্রিয়া গতানুগতিক গুণবতী সুন্দরীদের মতো ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছেলেদের সাথে কথা বলে না।
রাফিনের মেয়েটিকে মুগ্ধ করার মতো তেমন কোন গুণ নেই। তারপরও সে মেয়েটিকে তার পছন্দের কথা সাহস নিয়ে বলে ফেলেছে।
মেয়েটি তাকে বলে- আমি কেন আপনাকে পছন্দ করবো? আমাকে মুগ্ধ করার মতো কিছু কি করতে পারবেন?
রাফিন বলে- আমি তেমন কিছু করতে পারি না। তবে মুখের ধু ধু দিয়ে বরইয়ের মতো বেলুন বানিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি মনের ফানুস।
মৃদু হেঁসে অপ্রিয়া বললো- করে দেখান তো?
রাফিন সুচারুভাবে অপগুণটি করে দেখায় তাকে।
ছেলেটির এই কাণ্ড দেখে অপ্রিয়া রহস্যজনক হাসি হেঁসে বলে- এই যে এটা আমার মতো সুন্দরী মেয়েকে আকৃষ্ট বা মুগ্ধ করার জন্য যতেষ্ট না। আপনি যদি আমাকে মুগ্ধ করার মতো কোন কিছু কোনদিন করতে পারেন তবে আমি কথা দিচ্ছি, আপনার সাথে আমার কিছু একটা হবে। রাফিন এই কথা শুনে মনমরা হয়ে হলে ফিরে যায়। দিবস-রজনী ভাবতে থাকে মেয়েটিকে কিভাবে মুগ্ধ করা যায়।
মেয়েটি যেহেতু কবিতা ভালোবাসে তাই রাফিন অবশেষে সিদ্ধান্ত নেই কবিতা লিখে তাকে মুগ্ধ করবে।
রাতের অন্ধকারে লন্ঠন জ্বেলে রাফিন হেলাল হাফিজ, আসাদ চৌধুরী, সুনীল, নির্মলেন্দু গুন, শামসুল হকের রোমান্টিক কবিতা নিজের মতো করে লিখে প্রতিদিন অপ্রিয়াকে উপহার দেয়।
সে রাফিনের দেওয়া কবিতা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে সহজ-সরলভাবে বলে- এই কবিতাটা আপনি নির্মলেন্দু গুনের ‘কাশফুল’ কবিতাকে নকল করে লিখছেন। তবে কবিতাটিতে আপনার কবি প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে।
এভাবে যতদিন রাফিন কবিতা লিখে নিয়ে গেছে ততদিন অপ্রিয় বলেছে; এটা ঐ কবির ঐ কবিতা অনুসরণ করে লেখা। আসলে মেয়েটি কবিতার পোকা। হাতের নাগালে যত কবিতা আছে তা তার পড়া শেষ শুধু নয় অনেক কবিতা মুখস্ত।
একই ঘটনা বারবার ঘটাতে অপ্রিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে রাফিনকে বললো- শোনেন আপনার লেখার হাত ভালো। আপনি যদি সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন তবে মৌলিক একটা কবিতা লিখে আনবেন অনেক খুশি হবো।
অপ্রিয়ার মুখ দিয়ে লেখার হাত ভালো কথাটা শুনে রাফিনের মনে পরিতৃপ্তির সুবাতাস।
সে ফিরে গেলো মৌলিক কবিতা লিখবে বলে। সে লেখাপড়ার বাইরে যতটুকু সময় পায় অপ্রিয়াকে মুগ্ধ করতে কবিতা লেখার চেষ্টা করে। সে নিরন্তন চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু তার মনের ভাবাবেগ চুইয়ে কলমের কালিতে বের হচ্ছে না মনোপুত কোন করিতা। এজন্য মেয়েটির সাথে তার দেখাও হচ্ছেনা। কিভাবে হবে কবিতায় যে মেয়েটির সাথে দেখা করবার সেতুবন্ধন।
দিন কেটে যায়, সময় অতিবাহিত হয়, নির্ঘুম কাটে রাত! লন্ঠনের বাতি নিভে যায়, ঢাকা শহরের অশান্ত বাতি শান্ত হয়। কবিতা আর লেখা হয় না রাফিনের।
এভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা দিন।
হঠাৎ একদিন গভীর রাতে সে লিখে ফেলে একটা মৌলিক কবিতা। কবিতার নাম ‘না এসেও এসেছিলে’। রাত ভোর হলো। ছেলেটি ছুটে গেলো কার্জন হলের অপ্রিয়ার পদার্থ বিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে। রাফিন ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, সেমিনারসহ আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন খুঁজে অপ্রিয়াকে না পেয়ে তার এক কাছের ক্লাসমেটকে জিজ্ঞাসা করলো- অপ্রিয়া কোথায় বলতে পারবেন?
ক্লাসমেট বললো- আপনি জানেন না, গত দু’দিন হলো ও ফুল-ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে এমেরিকা চলে গেছে?
রাফিন বিস্ময়ের সাথে উত্তর দিলো- নাতো!
নিজের লেখা কবিতাটা মেয়েটিকে দেওয়া হলো না রাফিনের।
রাফিন মেয়েটিকে হারিয়ে অভিমানে-কষ্টে প্রতিরাতে রাত কেটে সকাল হবার আগ পর্যন্ত কবিতা লিখে!
এভাবে সে চার হাজার কবিতা লিখে ফেলেছে। এই কবিতা থেকে বেছে বেছে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছে সে। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কবিতার প্রজাপতি’
এখন সবাই তাকে কবি বলে ডাকে।
হয়তো সে কবি!
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন