বগুড়া শহরে আবদুল জোব্বারের পরিচিতি ছিল ‘ধলু মেকার’ নামে। কামারশালায় গরম লোহা পিটিয়ে বিকল যন্ত্র সারাতেন তিনি। প্রয়োজনমতো ছোট ছোট যন্ত্রাংশ তৈরিও করতেন। যন্ত্র সারাইয়ে আবদুল জোব্বারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। গত শতকের চল্লিশের দশকে তিনিই বগুড়া শহরের নিউমার্কেট এলাকায় হস্তচালিত একটি লেদ মেশিন স্থাপন করেন। সেখানেই তৈরি করতে থাকেন কৃষিকাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।
বাবা আবদুল জোব্বারের সেই কারখানাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল ছেলে আমির হোসেনের। তখন তাঁর বয়স সবে পাঁচ বছর। কে জানত, কামারশালায় গরম লোহা পিটিয়ে যন্ত্র তৈরি শেখা সেই আমির হোসেনই একদিন নামকরা উদ্ভাবক হবেন। ৫৯ বছর বয়সে এসেও আমির হোসেন নবতর উদ্ভাবনে মত্ত। উদ্ভাবনেই যেন তাঁর অপার আনন্দ।
বগুড়ার কাটনারপাড়া এলাকায় তাঁর উদ্ভাবন কক্ষ। ২৩ অক্টোবর সেখানে বসেই আমির হোসেন শোনালেন তাঁর উদ্ভাবক–জীবনের গল্প। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। আমিরের বয়স তখন সাত। স্কুলে সবে পা রেখেছেন। বাড়ির পাশে করনেশন ইনস্টিটিউশনে ক্লাস শেষে ছুটতেন বাবার সারাই কারখানায়। বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। ততদিনে তাঁর বাবার কারখানায় কাজের চাপ বেড়ে গেছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে পড়াশোনা ছাড়তে হয় আমির হোসেনকে। সারাই কারখানাই তখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
বাবার কামারশালাতে বসেই গরম লোহা পিটিয়ে শ্যালোযন্ত্রের পিস্টন, লাইনার, বুশ ভাল্বসহ নানা কৃষি যন্ত্রাংশ বানাতে থাকেন আমির হোসেন। ততদিনে বগুড়ায় বিদ্যুচ্চালিত লেদ মেশিন এসেছে। কৃষি যন্ত্রাংশের পাশাপাশি পানি তোলার জন্য সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প তৈরি করেন আমির হোসেন। ঠিক তখনই যেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের শুরু।
আমির হোসেন বলছিলেন, ‘১৯৮২ সালে আমি বিয়ে করি। বিয়েতে পরিবারের সম্মতি ছিল না। বাবা বেশ ক্ষুব্ধ হলে বাড়ি ছাড়তে হয়।’ স্ত্রী আলম আরা বেগমকে নিয়ে আমির হোসেন মামার বাসায় ওঠেন। কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তখন তিনি। কাজ নেন মামার চশমার দোকানে। বিনিময়ে পেতেন হাতখরচের টাকা। একদিন স্ত্রী পরামর্শ দিলেন আমির হোসেনকেই কিছু করতে। আমিরের প্রশ্ন ছিল, ‘পুঁজি পাব কই?’
সেই ব্যবস্থাও হলো। নিজের জমানো ৮০০ টাকার সঙ্গে স্ত্রী হাতে ধরিয়ে দিলেন সোনার এক জোড়া কানের দুল। আমির হোসেন বলছিলেন, ‘সব মিলিয়ে ২ হাজার টাকা হলো। এই পুঁজি নিয়ে শুরু করলাম কৃষি যন্ত্রাংশের ব্যবসা।’ দুটি ঢালাই কারখানা এবং দুটি লেদ ওয়ার্কশপের সঙ্গে চুক্তি করলেন। বাকিতে কৃষি যন্ত্রাংশ কিনে সারা দেশে সরবরাহ শুরু করলেন। ছয় মাস পর নিজেই পাম্প তৈরির কারখানা দিলেন।
আমির হোসেনের কারখানা থেকে একে একে তৈরি হলো সরু সেমাই ও নুডলস তৈরির যন্ত্র, ইট ও পাথর ভাঙার যন্ত্র, ইট তৈরির অত্যাধুনিক যন্ত্র, মাছের ও মুরগির খাদ্য তৈরির যন্ত্র, ভুট্টা ভাঙা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র, প্লাস্টিক পাইপ তৈরির যন্ত্র, গো–খাদ্যের যন্ত্র, পাটের ছাল ছাড়ানোর যন্ত্র, জ্বালানিবিহীন মোটরযান এবং উড়ন্ত গাড়ি, বিনোদন পার্কের রাইড, ডিশ অ্যানটেনা, ধান-আখ–গম মাড়াই যন্ত্র, বীজ বপন যন্ত্র, খোয়া-সিমেন্ট-বালু মেশানোর যন্ত্র, ধান কাটার যন্ত্র, বিস্কুট বানানোর যন্ত্র, অটোরিকশা, ভটভটি, গুটি ইউরিয়ার যন্ত্র, আলু উত্তোলন ও গ্রেডিং যন্ত্র, চাল গ্রেডিং যন্ত্র, রাইস পলিসার, অটোক্র্যাশার, অটো মিক্সচার, চিড়া-মুড়ি ভাজার যন্ত্র, ধানের খড় ও শুকনা ভুট্টার গাছ থেকে গো-খাদ্য তৈরির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রসহ অর্ধশতাধিক যন্ত্র। আমির হোসেন বললেন, ‘চীনের তৈরি অত্যাধুনিক ইটভাঙা যন্ত্রের আদলে ঘণ্টায় ২ হাজার ইট ভাঙার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যন্ত্র বানিয়েছিলাম। সেটা তো তিস্তা সেতু, লালন শাহ সেতুসহ দেশের বৃহৎ সেতু নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে।’
কথাটি বলতে গিয়ে তাঁর চোখেমুখে তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল। তখন জানালেন, এসব উদ্ভাবনের জন্য ২০০৪ সালে তাঁকে ‘রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ ডিগ্রি প্রদান করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
আমির হোসেনের হাত ধরে বগুড়ায় ঘটে যায় কৃষি যন্ত্রপাতি ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের অভাবনীয় বিপ্লব। গড়ে উঠেছে প্রায় এক হাজার কল-কারখানা। বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি কৃষি যন্ত্রাংশ এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পের বাজার তৈরি হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষের। শুধু অর্থনীতির চাকা সচল করেননি আমির, বিশ্বজুড়ে সুনাম ছড়িয়েছেন।
২০০৬ সালের দিকে আমির হোসেনের উদ্ভাবিত একটি প্রচলিত জ্বালানিবিহীন গাড়ির খবর ছাপা হয়েছিল দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে। ২০০৮ সালে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি মেলায় আমিরের সেই গাড়িটি প্রদর্শন করা হয়। সেবার সরকারিভাবে তিনি পুরস্কার অর্জনের পাশাপাশি ‘যন্ত্রবিজ্ঞানী’ খেতাব পান।
এরপর জাপানের টয়োটা এবং ভারতের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘টিভিএস’ কোম্পানির প্রতিনিধিদল আমিরকে জ্বালানিবিহীন গাড়ি বাজারজাতকরণের প্রস্তাব দেয়। আমির হোসেন বলছিলেন, ‘টয়োটার প্রস্তাব ছিল উদ্ভাবিত জ্বালানিবিহীন গাড়ি তৈরি হবে জাপানে। সেখানে সপরিবার বসবাসের জন্য নাগরিকত্ব প্রদানেরও ব্যবস্থা করবে তারা। গাড়ি তৈরির কার্যক্রম তদারকি করা হবে আমার কাজ। মাসিক ভালো বেতনও প্রদানের প্রস্তাব করা হয়।’ কিন্তু টয়োটার এই প্রস্তাবে সাড়া দেননি আমির। কারণ, গাড়িতে লেখা থাকবে না ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।
আমির বলে যান, ‘এ দেশের মাটিতে বছরের পর বছর ধরে এত কষ্টে উদ্ভাবন করেছি, সেই যন্ত্রের কৃতিত্ব নেবে অন্য দেশ, সেটা মানতে পারিনি। এ দেশের মাটি, কৃষক ও কৃষির প্রতি আমার প্রাণ বাঁধা রয়েছে। এ কারণে নিত্য নতুন কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবনের সাধনা করে গেছি। এ দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না।’সৌজন্যে- প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন