কদিন ধরে ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে হাসিখুশি এক তরুণীর ছবি। তাঁর ছবি শেয়ার করে অভিনন্দন জানিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ লিখেছেন, নাসায় যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের মেয়ে মাহজাবীন হক। তাঁর জন্য শুভকামনা। বিস্তারিত জানতে আমরা স্বয়ং মাহজাবীন হকের সঙ্গেই যোগাযোগ করলাম। মেসেঞ্জারে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি শোনালেন, সিলেটের দ্য খাজাঞ্চিবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, নাসায় পৌঁছে যাওয়ার গল্প। শুরুতে শিক্ষানবিশ হিসেবে নাসায় কাজ শুরু করেছিলেন মাহজাবীন। তবে আগামী ৭ অক্টোবর থেকে তিনি পুরোদস্তুর স্পেস সিস্টেম সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেবেন এই বিখ্যাত গবেষণা সংস্থায়।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার কদমরসুল গ্রামে মাহজাবীনদের বাড়ি। বেড়ে উঠেছেন সিলেট শহরের কাজিটুলা এলাকায়। তাঁর বাবা সৈয়দ এনামুল হক পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। মা ফেরদৌসী চৌধুরী। দুই ভাইবোনের মধ্যে মাহজাবীন বড়। ছোট ভাই সৈয়দ সামিউল হক যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে থাকেন মাহজাবীন।
‘তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান দেখে নাসায় কাজ করার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখার শুরু।’ বলছিলেন মাহজাবীন হক। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সিলেটেই লেখাপড়া করেছেন তিনি। এরপর ২০০৯ সালে ডাইভারসিটি ভিসা (ডিভি) নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরষ্ট্রে। শুরুতে নিউইয়র্কের উইলিয়াম কলেন ব্রায়ান্ট হাইস্কুলে ভর্তি হন। ২০১১ সালে তাঁরা চলে যান মিশিগান শহরে। সেখানে ভর্তি হন হ্যামট্র্যাক হাইস্কুলে।
বাবা চাইতেন মেয়ে চিকিৎসক হোক। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে প্রি-মেডিকেলে ক্লাসও শুরু করেছিলেন মাহজাবীন হক। শুরুতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু ছেলেবেলার স্বপ্নটা তখনো ভেতরে-ভেতরে জেগে ছিল। অতএব ২০১৪ সালে মেডিকেল স্কুল ছেড়ে ভর্তি হন মিশিগানের ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে। পড়ার পাশাপাশি একাধিকবার শিক্ষানবিশ (ইন্টার্নি) হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পিৎজা কোম্পানি লিটল সিজারস করপোরেটের প্রধান কার্যালয়ে শেয়ারপয়েন্ট ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেন। পরে দুই দফায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছেন নাসায়। প্রথমে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নাসার শিক্ষানবিশ ডেটা অ্যানালিস্ট ছিলেন। পরে এ বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে শিক্ষানবিশ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষানবিশদের এই দলে একমাত্র বাংলাদেশি ছিলেন তিনি। সে সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাসার রকেট পার্কে বাংলা গান গেয়েছেন, বাংলা গানের সঙ্গে নেচেছেনও মাহজাবীন।
মেডিকেল ছেড়ে প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াটা অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। এমনকি এখনো অনেকে মিশিগান থেকে টেক্সাসে গিয়ে নাসায় কাজ করাকে সমর্থন দিচ্ছেন না। তবে শুরু থেকেই মেয়ের পাশে আছেন মা ফেরদৌসী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি আমার মেয়ের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া হোক। এখন ওকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।’ মাহজাবীনও তাঁর সব কৃতিত্ব দিলেন মাকে, ‘মা সব সময় কঠোর পরিশ্রম করতে বলতেন। বলতেন, আমি যেন হাল না ছাড়ি। যত দূর এসেছি, তার পেছনে মায়ের ভূমিকাই প্রধান।’
মাহজাবীনের পরামর্শ
নাসায় যোগ দিতে হলে পরীক্ষার ফল নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে কথা জোর দিয়েই বললেন মাহজাবীন হক। ‘নাসা চায় অলরাউন্ডার। খুব ভালো রেজাল্ট থাকতে হবে তা নয়। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে হবে। আর থাকতে হবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ,’ বলছিলেন তিনি। ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠনের সভাপতি ছিলেন মাহজাবীন। নাচ, গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল।
বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক সময় সমাজের নানা বাধার কারণে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পায় না, পছন্দের কাজটা করতে পারে না, সে কথা উল্লেখ করে নাসার এই সফটওয়্যার প্রকৌশলী বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি তাঁদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারি। আমি প্রকৌশলে পড়া শুরু করার পর থেকে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি, এখনো হচ্ছি। তবু বলব, আপনি আপনার পছন্দের বিষয়কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন, সফলতা একদিন না একদিন আসবে।’
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন