রাশিদা বানু তিথি, থাকেন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। চাকরি করেন রাজধানীর আসাদগেটে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার হিসেবে। প্রতিদিনের মতো গত ২৮ জুলাই ২০১৯ অফিস করেন। হঠাৎ শরীরে জ্বর অনুভব করেন। দেরি না করে বাসায় ফেরেন। বাসায় এসে রাত যেমন বাড়তে থাকে জ্বরে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে যায়। পরদিন ২৯ জুলাই রক্তের পরীক্ষা করান এবং ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়ে। জ্বরের সাথে সাথে বমি, শরীর ব্যথা, প্রেসার কমে যাওয়া, শরীরে চুলকানিও বাড়তে থাকে। প্লাটিলেট কমে যায়, টেনশনও বাড়তে থাকে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছুটে বেড়ান। কোথাও সিট খালি না পেয়ে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বাসায় চিকিৎসা শুরু করেন। বাসায় নিয়মিত একজন নার্সের তদারকিতে থাকেন। খাবারে পরিবর্তন আনেন। নিয়মিত বিশ্রাম নেন। প্লাটিলেট বাড়তে থাকে। এক সপ্তাহ পর জ্বর কমে যায়, শরীরেও কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এখন নিয়মিত অফিসও করছেন।
ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মম-লীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ে মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক ধারণ করতে পারে, যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দেয়।
আমিনুর রহমান। ঢাকার গাওছিয়া মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসায়ী। থাকেন মিরপুর বর্ধিত পল্লবী এলাকায়। বন্ধের দিন ব্যতিরেকে প্রতিদিন দোকানে বসেন। গত ৪ আগস্ট রাতে বাসায় মলীরের তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। জ্বর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। জ্বরের তৃতীয় দিন রক্ত পরীক্ষায় শরীরে ডেঙ্গু রোগের উপস্থিতি ধরা পড়ে। দেরি না করে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। আগে থেকেই আমিনুর ডায়াবেটিস ও হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত। অসুস্থ হওয়ার ৫ দিন পর রক্তে প্লাটিলেট নেমে আসে ৯ হাজারে। ও নেগেটিভ রক্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েন। কিন্তু পরিচিত অপরিচিত অনেকেই এগিয়ে আসেন রক্ত দানে। চিকিৎসা চলতে থাকে। রোগীও সুন্থ হতে থাকে। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর রক্তের প্লাটিলেট বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ২৮ হাজারে উন্নিত হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন বাসায় অবস্থান করছেন, নিয়মিত বিশ্রাম নিচ্ছেন।
মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন, কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়শ রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে কোন ধরণের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল ঔষধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আমিনুর কিংবা তিথি, দুজনের মতে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক করা যাবেনা। মনোবল ও আত্মবিশ্বাস হারানো যাবেনা। সঠিক মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরল করলে ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নিজেকে সচেতন হতে হবে। নিজের নিরাপত্তার জন্য, নিজেকে যাতে মশা কামড় দিতে না পাওে সেদিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে। অনেকের মতে এডিস মশা রাতে কামড়ায় না, কিস্তু পর্যাপ্ত আলো থাকলে রাতেও কামরাতে পাওে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন। নিজের ও সন্তানের কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদেরকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। শিশুরা যখন স্কুলে যায়, তারা ফুল হাতা শার্ট ও প্যানট পরিধান করছে কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ বিদ্যালয়ে মশা কামড়ানোর সুযোগ থাকে।
ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই পারে ডেঙ্গু থেকে আমাদের মুক্ত রাখতে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে এডিস মশার বিস্তার রোধ করা গেলে ডেঙ্গু রোগের হার কমে যাবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন