প্রতিবন্ধী এক কিশোর অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করছে, ‘মা, তুমি কেমন আছ?’ উত্তরে প্রায় ৭০ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নারী বাংলায় বলছেন, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? কী করছ তুমি?’
ব্রিটিশ এই নারীর নাম প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার। তিনি নাম-পরিচয়হীন তিন সহস্রাধিক ছিন্নমূল শিশু-কিশোরের ‘মা’।
প্যাট্রিসিয়া গাজীপুরের শ্রীপুরের টেংরা গ্রামের ‘শিশুপল্লী প্লাস’ নামের একটি মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠানটি শিশুদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি মায়েদের বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে ভালোভাবে বাঁচতে শেখায়। কেন্দ্রের ভেতরে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, হস্তশিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চিকিৎসা কেন্দ্র, কাগজ তৈরির কারখানা, ফসলের মাঠ, ফলের বাগান ও মসজিদ। প্রায় ৫১ বিঘা জায়গাজুড়ে কেন্দ্রটি যাত্রা শুরু করে ১৯৮৯ সালে। নিজের জীবনের সব সঞ্চয় ও বিভিন্ন পর্যায় থেকে সহযোগিতা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রম বিবেচনায় প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব।
প্যাট্রিসিয়ার স্বামী ডেরেক পালমার তাঁর দেশে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাঁদের কোনো সন্তান নেই। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি নেন প্যাট্রিসিয়া। তখন বাংলাদেশ প্রায়ই আসা হতো। তবে ১৯৮০ সালে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানীর ফার্মগেটে ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ নামের একটি আশ্রম পরিদর্শনে আসেন। সেখানকার বিভিন্ন গল্প শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মা ও শিশুকে একসঙ্গে পুনর্বাসন করবেন। ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ নামের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক মাস অবস্থান করেন অভিজ্ঞতার জন্য। পরে ১২০ জন মা ও শিশুকে নিয়ে অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। কেবিন ক্রুর চাকরিটা ছেড়ে দেন। পরে গাজীপুরে স্থায়ীভাবে কেন্দ্রটি চালু করেন। এমন উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়ান ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান লর্ড কিংসহ কয়েকজন কর্মী। পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা নারীদের মধ্য থেকে তৈরি করছেন নারী ক্রিকেটার। সম্প্রতি শ্রীপুর ক্রিকেট ক্লাবের একটি টুর্নামেন্টেও অংশ নিয়েছে তারা।
এ টুর্নামেন্ট থেকে বের হয়েছে ‘ভাওয়ালিকা উইমেন্স ক্রিকেট টিম’ নামের একটি দল। এতে তেলিহাটি ইউনিয়নের ছয়টি স্কুল অংশ নেয়।
সম্প্রতি শিশুপল্লী প্লাসে গিয়ে দেখা যায়, কাগজ তৈরিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সবাই খুব ব্যস্ত। এখানে তৈরি কাগজগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প তৈরি হয়। কিছু কাগজ বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। তা ছাড়া এখানে বুটিক ও হস্তশিল্প নিয়ে যে বিভাগ চালু আছে, সেখানে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে বাহারি পণ্য, যা বিদেশে যাচ্ছে সগৌরবে। শিশুপল্লী প্লাসজুড়ে বিশাল মাঠে শিশুরা আপন মনে খেলাধুলা করছে।
প্যাট্রিসিয়া জানালেন, চলতি বছর নারী ও শিশুদের ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতা ও মর্যাদা—এই তিন বিষয় নিয়ে কার্যক্রম চলছে। শিশু-কিশোরদের শিক্ষিত করে আধুনিক যুগের উপযোগী করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার, অনলাইন ব্যাংকিংসহ আধুনিক সমাজে কীভাবে তারা চলবে, তাও শেখানো হচ্ছে।
ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে প্যাট্রিসিয়া কেন্দ্রটি শুরু করেছেন। শিশুপল্লী প্লাসের বিশাল কম্পাউন্ডেই তাঁর থাকার ঘর। নিজের ব্যক্তিগত কাজ শেষ করেই তিনি বেরিয়ে পড়েন সন্তানদের দেখতে। কোনো বিশেষ দিনে শিশুদের সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করেন। নিজ হাতে খাইয়ে দেন অনেককে। ছেলেমেয়েরা বড় হলে বিয়ে দেন, তারপর বিভিন্ন উৎসবে ছেলেমেয়েরা এখানেই বেড়াতে আসেন।
গত ৮ এপ্রিলের হিসাব অনুযায়ী, শিশুপল্লী প্লাসে মা ও শিশু মিলিয়ে মোট ৫১২ জন ছিল। আর শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৮ জন মা ও ৩ হাজার ৩৮৫ জন শিশুকে এ কেন্দ্র থেকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর প্যাট্রিসিয়া সম্পর্কে বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই এটা একটা অনন্য দৃষ্টান্ত। প্যাট্রিসিয়ার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের পুরোটাই এখানে ব্যয় করেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন