মানসিক হতাশা কিংবা সামাজিক কোনো বাধাই নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়া রুখতে পারে না। নারী যদি সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নেয় তাকে কেউ আটকাতেও পারে না। তার প্রমাণ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গণ। বাংলাদেশের নারী যেমন ঘর সাজানো, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে সফল তেমনি সফলতার ছাপ রেখেছেন ক্রীড়াঙ্গণেও। স্বাধীনতার পর একটু একটু করে ক্রীড়াঙ্গণে পদচারণা শুরু হয় নারীদের। আজ নারীরাই সমান অধিকার নিয়ে ক্রীড়াঙ্গণে জায়গা করে নিয়েছে।
নারী ক্রীড়াবিদদের হাত ধরে কম সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ। তারা দেশের বাইরে বাংলাদেশের পতাকাও বহন করছে। বিদেশের মাটিতে ফুটবল, সাঁতার, কাবাডি, শুটিং, ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জিতে বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীত প্রচার করেছেন এই নারীরা।
জাতীয় প্রতিযোগিতায় পুরুষ থেকে পিছিয়ে নেই নারীরা। নারীরা ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, দাবা টেনিস, টেবিল টেনিস, ভারোত্তোলন, কাবাডি, কুস্তি, হ্যান্ডবল, ভলিবল, শুটিংসহ বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টে অংশ নিয়ে আসছে। জোবরা রহমান লিনু ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম তুলে ইতিহাস তৈরি করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন সালমা-খাদিজারা। দৌড়ে দ্রুততম মানবী নাজমুন্নাহার বিউটি। দক্ষিণ এশিয়া ১২তম এসএ গেমসে সীমান্ত এবং শীলা স্বর্ণ জিতে ইতিহাস রচনা করেছেন। খেলার ঝুলিতে এরকম অসংখ্য সাফল্য রয়েছে এখন বাংলাদেশের নারীদের। জাতীয় প্রতিযোগিতা করে গিনেস বুকে বাংলাদেশের কোনো পুরুষ খেলোয়াড় নাম তুলতে পারেনি। এখানেই নারী এগিয়ে। বাংলাদেশের শুরু নারী সমাজের নয়, গোটা জাতির অহংকার এই লিনু। ফুটবলে নারীদের সাফল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৮ সাফ ফুটবলে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাফ অনুর্ধ্ব ১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়ান শিপের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ফাইনালে ১-০ গোলে হারায় ভারতকে। চ্যাম্পিয়ান ট্রফির পাশাপাশি ফেয়ার পেন্ট ট্রফিও পায় বাংলাদেশ। ক্রিকেটেও নারীদের ঈষর্ণীয় অর্জন অনেক। এশিয়ার পরাশক্তি ভারতকে ফাইনালে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটদল। টানা পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বে নজির স্থাপন করে মেয়েরা। এছাড়াও আইসিসি নারী বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বড়ো জয় পেয়েছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটদল। ক্রিকেটে নারীরা শুধু জাতীয় লীগ নয় এশিয়া কাপ ক্রিকেট, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো বড়ো আসরে প্রতিনিধিত্ব করেছে।
দাবা জনপ্রিয় ইভেন্টের মধ্যে একটি। আশির দশকে একাধিকবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ। বিদেশেও তিনি দুর্দান্ত পারফরম করেছেন। এর পরেই ইয়াসমিন বেগম, শাবানা পারভীন নিপা ও শামীমা আক্তার লিজাসহ আরো অনেক নারী জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। শুটিংয়ে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে নব্বই দশকে এই ইভেন্টে নারীদের উত্থান। গত ২৫ বছরে শত শত নারী শুটার সৃষ্টি করেছে শুটিং ফেডারেশন। এই শুটাররা জাতীয় প্রতিযোগিতায় নিয়মিতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
জাতীয অ্যাথলেটিকসের ৪০তম আসরের দ্রুততম মানবী হয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শিরিন। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশীয় গেমসে ৬৩ কেজি শ্রেণিতে স্বর্ণপদক জয় করেন মারিয়া আক্তার সীমান্ত। আশির দশক থেকে সাঁতার আঙ্গিনায় প্রবেশ করে নারী সাঁতারুরা। নব্বই দশকেই মূলত সাঁতারে প্রভাব বিস্তার করে নারী সাতারুরা । জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক পেলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বর্ণপদক অর্জিত হয়নি। নারীদের এই অর্জনগুলো এসেছে মফস্বলের মেয়েদের হাত ধরেই। খেলাধুলায় শহরের মেয়েদের অংশগ্রহণ কম।
খেলাধুলায় নারীদের যতটা সাফল্য বেড়েছে, ততটা অংশগ্রহণ বাড়েনি। আর যেটুকু অংশগ্রহণ হয়েছে তারও অধিকাংশ গ্রামীণ ও দরিদ্র পরিবারের মাঝেই। শিক্ষিত ও অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মেয়েদের এখনও সেভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮০ শতাংশের বেশি আসেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের স্বপ্ন থাকে, খেলায় দক্ষতা দিয়ে চাকরি পেয়ে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। কিন্তু চাকরি পাওয়ার হার খুব কম। আর্থিক এই অনিশ্চয়তাই খেলাধুলায় নারীদের কম আসার প্রধান কারণ। এছাড়া মৌলিক চাহিদার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবারের বিরোধিতা এবং অসহযোগিতা, নারীদের বিশেষায়িত ক্লাব না থাকা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট না হওয়া এবং অনুশীলনের জায়গার অভাব। গবেষণায় দেখা যায়, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা আনসার, ভিডিপি পুলিশ, বিজেএমসি সার্ভিস টিমে খেলা, যাতে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে পারে এবং ভালো প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেকে আরও দক্ষ করতে পারে।
তাদের জন্য সাধারণ পুষ্টিসম্পন্ন খাবার কেনাও কষ্টসাধ্য বিষয় হয়। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। বেশিরভাগ নারী খেলোয়াড় খেলতে আসেন কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া। এজন্য তারা প্রশিক্ষণের উপযুক্ত স্থানের সংকট, ঘরের কাজে সময় দেওয়া ও নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেন।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সাফল্যকে ধরে রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো সফলতার স্বাক্ষর রাখতে আন্তর্জাতিক মানের কোচ, ফিজিও রাখাসহ তাদের উন্নত নিউট্রেশন ব্যবস্থা এবং জিমনেশিয়াম ব্যবহারের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া নারী খেলোয়াড়দের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নারী খেলোয়াড়দের অনুশীলনের সুযোগ বাড়াতে বিদেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পূর্বে তাদের ক্যাম্পিং এর সময় বাড়ানো এবং তাদের সাথে নারী কর্মকর্তাদের রাখার সুব্যবস্থা করেছে সরকার।
নারীরা খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত থাকলে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে শিক্ষার হার নেতৃত্বগুণ বাড়ানো ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানো যাবে। ফলে নারীর ক্ষমতায়নও হবে। খেলাধুলায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে অনেক অসামাজিক কার্যক্রম কমে যাবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, খেলাধুলা নারীদের শারীরিক শক্তি-সামর্থ অর্জনের পাশাপাশি মানসিক বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক। খেলাধুলা আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। সুষ্ঠু এবং গঠনমূলক চিন্তা করতে খেলাধুলা ভূমিকা রাখতে পারে।
নিজেকে আটপৌরে শাড়ির মধ্যে আটকে না রেখে দরজার বাইরে আলোকিত পৃথিবী দেখার সরল রেখাটা সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীরাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। বাঙালি নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ভিত তৈরি করতে পথ দেখিয়েছেন যারা, তাদের অনুসরণ করে কোটি কোটি বাঙালি নারী এখন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। আছেন খেলাধুলায়। খেলার মাঠে মেয়েদের সফল এই পদচারণা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন