প্রাণচঞ্চল, উদ্যমী, মেধাবী মেয়ে সাথি। পরিবারের সকলের চোখের মণি। শিক্ষক, পরিবার, অাত্মীয়-স্বজন সকলের অাশা ছিল মেয়ে এসএসসি তে জিপিএ-৫ পাবে। তবে কোনোভাবে জিপিএ-৫ মিস করে গেলো সে!
মেয়ে রেজাল্ট ভালো না করায় পরিবারের লোকেরাও রূঢ় ব্যবহার শুরু করলো। অাবার বন্ধু-বান্ধব, অাত্মীয়-স্বজন থেকেও দিনেদিনে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলো সে। শুরু হলো নিজের সাথে নিজের মানসিক দ্বন্দ্ব।
মাস তিনেক পরে হঠাৎ একদিন মেয়েটার হাত পা অবশ হয়ে গেলো এরপর খিচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। স্থানীয় ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও পরবর্তীতে দেখা গেলো মেয়েটা হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে, তাকে ঢাকায় নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও চিকিৎসক সাথির শরীরে কোনো রোগ খুঁজে পেলেন না।
পরে জানা গেলো সাথি মানসিক রোগে অাক্রান্ত
এবং রোগটির নাম "কনভারশন ডিসঅর্ডার"।
"কনভারশন ডিসঅর্ডার" একটি মানসিক রোগ কিন্তু এর উপসর্গগুলো শারীরিক। প্রথমে এটিকে হিস্টিরিয়া বলা হতো। হিস্টিরিয়া শব্দের অর্থ জরায়ু, অাগে এটাকে জরায়ুর রোগ বলেই গণ্য করা হতো। পরবর্তিতে এটাকে ব্রেইনের রোগ হিসেবে ধরা হয়। অাসলে এটা মানসিক দ্বন্দ্বের শারীরিক বহিঃপ্রকাশ।
রোগের কারণঃ
০১. জেনেটিক
০২. সাইকো ডায়ানমিক
০৩. পরিবেশগত মানসিক চাপ বা দ্বন্দ্ব, সামাজিক সমস্যা
০৪. অস্বাভাবিক অাচরণ
০৫. কালচারাল প্রভাব
০৬. সম্পর্কের জটিলতা
০৭. দুর্বলতা
০৮. দুশ্চিন্তা, অবসাদ
০৯. বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তি।
রোগের লক্ষণ :
০১. ব্যাথা বা স্পর্শের অনুভূতি কমে যাওয়া বা না থাকা।
০২. অন্ধত্ব
০৩. কানে না শোনা
০৪. একটি বস্তু দুটি দেখা
০৫. ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন যাতে চোখে এমন কিছু দেখতে পাওয়া যা শুধু রোগী দেখতে পাবে
০৬. প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ের স্বাভাবিকতা হ্রাস পাওয়া
০৭. গিলতে অসুবিধা হওয়া
০৮. শ্বাসকষ্ট
০৯. বারবার জ্ঞান হারানো।
ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ঃ
যে সকল বিষয়ের কারণে এ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় সেগুলো হলোঃ
০১. যে কোনো মানসিক অাঘাত বা চাপ
০২. মহিলাদের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়
০৩. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। যেমন- মন মেজাজ অথবা দুশ্চিন্তাজনিত সমস্যা এবং পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার।
০৪. পরিবারের অন্যকারো এ সমস্যা থাকলে
০৫. শারীরিক অথবা যৌন হয়রানির শিকার হলে এবং শৈশবে অবহেলায় বড় হলে।
কাদের এ রোগের সম্ভাবনা বেশিঃ
অল্পবয়সী মেয়েদের এই রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে পুরুষেরাও এ রোগে অাক্রান্ত হতে পারেন। মূলত মানসিক দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ থেকেই এ রোগ বেশি হয়। চাওয়ার সাথে পাওয়া না মেলা, সম্পর্কে জটিলতা থেকেও এ রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাছাড়া মেয়েরা নিজেদের মানসিক অবস্থার কথা কাউকে প্রকাশ করতে চায় না। এ প্রকাশ না করার ফলে একসময় এটা মারাত্মক অাকার ধারণ করে।
চিকিৎসা এবং প্রতিকারের উপায়:
সাইকোলজিক্যাল প্রধান চিকিৎসা। রোগী এবং তার স্বজনদের সাহস দিতে হবে, অাশ্বস্ত করতে হবে। তারপর রোগীর সেবার দিকে নজর দিতে নিষেধ করতে হবে পরিবারকে। অর্থাৎ শ্বাসকষ্টের রোগীকে অক্সিজেন, প্যারালাইজড রোগীকে হুইলচেয়ার দেয়া যাবে না কোনোভাবেই, তবে এ রোগ স্থায়ী রূপ ধারণ করবে।
রোগের কারণ খুঁজে বের করে দ্রুত সমাধান বের করতে হবে। রোগীকে স্বাভাবিক কাজকর্মে লাগাতে হবে। সবার উচিৎ রোগীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, তাকে সময় দেওয়া, সুন্দর স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করা।
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে যোগব্যায়াম, প্রার্থনা ও ধ্যান করতে হবে। ভালো সাইকার্টিস্টের কাছ থেকে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ নিতে হবে।
শারীরিক সমস্যাকে প্রায়োরিটি দিলেও মানসিক সমস্যাকে অামরা অামলে নিতে চায় না। কিন্তু "কনভারশন ডিসঅর্ডার" এ অাক্রান্ত রোগীর শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলেও সেটা অাসলে মানসিক সমস্যা। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় অাক্রান্ত। তবে নিজেদের অবহেলায় এ সমস্যা একসময় প্রকট অাকার ধারণ করে। প্রত্যেকের উচিৎ মানসিক সমস্যাকেও শারীরিক সমস্যার মতো সমান চোখে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা। প্রিয়জনকে ভালোবাসুন, তাকে সময় দিন এবং তার মনে মেঘ হয়ে থাকা কথাগুলোর খবর রাখুন।
.
লেখকঃ শিক্ষার্থী,কেসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ,ঝিনাইদহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন