পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবশেষে স্কুল খোলা নিয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা রয়েছে। তবে করোনার এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বরে খুলছে না বলেই সংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় পাবলিক পরীক্ষা এইচএসসি পরীক্ষা এখনও নেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামীতে কখন হতে পারে- এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছে না। পিইসি পরীক্ষা না হলেও জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষা আলোচনা চলছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষায় বসানো যাবে কিনা- সেই আলোচনা চললেও অতি সম্প্রতি নিজ নিজ স্কুলে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পর্যায়ে এসেছে। এতে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক উভয়ের মনেই এক ধরনের শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো উপায়েই লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পরীক্ষায় বসানোর বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ বলেই বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ উন্নত বিশ্বের বিরূপ অভিজ্ঞতায় এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার যৌক্তিকতা বিবেচনার বিষয়টি সামনে আসছে। আমার মতো অনেক অভিভাবকই মনে করবেন, শিশুদের কিছুদিনের শিক্ষা কার্যক্রমের চেয়ে জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাসে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে পাঠদানের চিন্তা পরিহার করে ভিন্ন উপায়ে চলতি একাডেমিক বর্ষটি অতিক্রম করার বিষয়টি ভাবনায় আনা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে গত জুলাইয়ে স্কুল খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। সেখানে দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে প্রমাণ করা হয়েছে।
আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলতে নির্দেশিকা তৈরি করছে বলে খবরে এসেছে। করোনাভাইরাসের এখনও যে ধরনের প্রকোপ এবং বাস্তবতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমনটি পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে, তাতে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার যৌক্তিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পাঠদান শুরু করার বিষয়ে ১৫-১৬টির মতো খসড়া নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে এবং বিদ্যালয় খুললে তাদের সেগুলো পালন করতে হবে বলে জানানো হয়েছে। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বিদ্যালয় খুলে দিলে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে স্কুলে প্রবেশ করতে দেওয়া, যাদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকবে তাদের বিদ্যালয়ে ঢুকতে না দেওয়া। স্কুলে প্রবেশের আগে অবশ্যই হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে যাওয়া প্রভৃতি। এ বিষয়গুলো হয়তো বাচ্চাদের কেউ শিখিয়ে দিলে অথবা পালন করার জন্য যথাযথভাবে দেখভাল করলে বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেগুলো আদৌ সম্ভব কিনা- সেটিও ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবার হচ্ছে না। পরীক্ষাটি একেবারে না হলেই মঙ্গল। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বিষয়ে কোনো প্রকার ইঙ্গিতও নেই। অথচ প্রতিনিয়ত পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ূয়া একটি শিশুকে এত বড় প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করে দিয়ে তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকেই বরং বাধা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নিয়ে এমন ধরনের টানাপোড়েন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আকর্ষণের পরিবর্তে ভয়ই বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগে উচ্চশিক্ষার পাবলিক পরীক্ষা ছিল দুটি- এসএসসি ও এইচএসসি। এখন পাবলিক পরীক্ষা দাঁড়িয়েছে চারটিতে- পঞ্চম শ্রেণির পর পিইসি, অষ্টম শ্রেণির পর জেএসসি আর এসএসসি এবং এইচএসসি তো আছেই। বিদ্যমান শিক্ষানীতির একুশতম অধ্যায় 'পরীক্ষা ও মূল্যায়ন'। অধ্যায়টিতে 'পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা-পৌরসভা-থানা (বড় বড় শহর) পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে' এবং 'অষ্টম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আপাতত এ পরীক্ষার নাম হবে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি)।' এ ছাড়াও উল্লেখ আছে, 'দশম শ্রেণি শেষে জাতীয় ভিত্তিতে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষার নাম হবে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি)। দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আরও একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এর নাম হবে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এইচএসসি)।'
পৃথিবীর কোনো দেশে পঞ্চম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে পরীক্ষা তো হয়ই, বরং তা নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলাও হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষার মুখোমুখি করার অর্থই হচ্ছে মানসিকভাবে শিশুকে ভারাক্রান্ত করে তোলা। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো নৈতিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন করা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং পরবর্তী স্তরে শিক্ষালাভের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য এই করোনা পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার কতটুকু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।
শিশুশিক্ষাকে অধিকতর আনন্দময় ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে চাইলে করোনার প্রকোপ চলাকালীন কোনোভাবেই শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানো যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা- সেটি নিয়ে অধিকতর ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াতে শিশু মানসিক বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন