অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটির সাসটেইনেবল অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের সহযোগী অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় পেয়েছেন পিভিসি অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং ২০২০। শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ মূল্যায়নে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। শিক্ষকতার ধরন এবং কর্মস্থলের উপযোগী পাঠদান পদ্ধতির জন্য তিনি ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মারডক বিজনেস স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছিলেন। গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন রিসার্চ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড।
সেরা শিক্ষকের খেতাব অর্জন মানেই যেন মোয়াজ্জেম হোসেন। এই সাফল্য বারবার ধরা দিয়েছে তার হাতে। মূলত শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ মূল্যায়নে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেরা শিক্ষক নির্বাচন করা হয়। সেই প্রক্রিয়ায় ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মারডক বিজনেস স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। এর পেছনে ছিল তার শিক্ষকতার ধরন এবং কর্মস্থলের উপযোগী পাঠদান পদ্ধতি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণাও করছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন রিসার্চ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। চলতি বছরে পেয়েছেন পিভিসি অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং ২০২০।
জীবন বদলে দেওয়া ই-মেইল
মোয়াজ্জেম হোসেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের ও মারডক ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ কমিউনিটির জনপ্রিয় মুখ। মারডক ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যে কোনো প্রয়োজনে তিনি সদা জাগ্রত। মোয়াজ্জেম হোসেন নিজের পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, 'আমি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণাও করেছি। বের করেছি তাদের উপভোগ্য পাঠদান পদ্ধতি। আমার কোর্সের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস উদযাপন করে। কোর্স শেষে তারা আমার জন্য ফুল নিয়ে আসে, কেউ আবার খাবার নিয়ে হাজির হয়। একবার এক ছাত্র ই-মেইল করে জানাল যে, আমি তার জীবন বদলে দিয়েছি। এমন অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি এই ক্ষুদ্র শিক্ষক জীবনে। এটা যখন এসব ভাবি, তখন নিজেকে খুব সফল মনে হয় এবং বর্ণিল হয়ে যায় মন।' এ ছাড়া নিজের শিক্ষক সত্তাকে সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, 'একজন শিক্ষক মানুষের জীবন বদলে দিতে পারেন, পৃথিবী বদলে দিতে পারেন। আমি সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পারছি, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। আমার ক্লাসে প্রায় ৫৭ জাতিসত্তার শিক্ষার্থী আছে। আমি কাজ করি তাদের নানা দক্ষতার উন্নয়ন নিয়ে। এরা ছড়িয়ে যায় পৃথিবীব্যাপী; বিকশিত করে নিজেদের। আমি যে ওদের জন্য কিছু করতে পারছি, এটাই আমার অর্জন।'
বেড়ে ওঠা
মোয়াজ্জেমের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার রমজানপুর ইউনিয়নের উত্তর চর আইর কান্দি গ্রামে। এই গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। চর আইর কান্দি গ্রাম থেকে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না মোয়াজ্জেম হোসেনের জন্য। তিনি এসএসসিতে পাস করে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এইচএসসি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১৬তম স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। পিএইচডি করেন বিখ্যাত কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোয়াজ্জেমের বাবা মফিজউদ্দিন সরদার ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা দেলোয়ার বেগম ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিণী। ২০১৭ সালে বাবা এবং মা ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে মোয়াজ্জেম সবার বড়। ব্যক্তিগত জীবনে মোয়াজ্জেম এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা।
বাবার বকুনি ও বদলে যাওয়া মোয়াজ্জেম
নবম শ্রেণির গণিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর বকুনি খান স্কুলশিক্ষক বাবার। জেদ চাপে মনে। শুরু করেন কঠোর অধ্যবসায়। নিয়মিত অধ্যয়নের পর গণিতে শুধু ভালো নম্বরই পাননি, ঢাকা বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের তালিকায় শুরুর দিকেই নাম ওঠে মোয়াজ্জেমের। গণিতে ফেল করার পর বাবার সেই বকুনিকেই জীবন বদলে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
যত অর্জন
ড. মোয়াজ্জেম 'কোলাবরেটিভ লার্নিং ইউজিং এডুকেশনাল টেকনোলজিস ইন ব্লেন্ডেড লার্নিং এনভায়রনমেন্ট'-এর একজন অভিজ্ঞ একাডেমিক। ছোটবেলা থেকে তিনি অত্যন্ত মেধাবী। মোয়াজ্জেম হোসেন মেম্বার অব ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব অস্ট্রেলিয়া। তিনি অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও অ্যাসোসিয়েট অব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইউকে। এমনকি কারিকুলাম ডিজাইন, এডুকেশনাল টেকনোলজিভিত্তিক স্টুডেন্ট এনগেজমেন্টে দক্ষতার জন্য যুক্তরাজ্যের হায়ার এডুকেশন একাডেমি থেকে ফেলোশিপ অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি আমেরিকান অ্যাকাউন্টিং অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স অ্যাসোসিয়েশন, ইউরোপিয়ান অ্যাকাউন্টিং অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিং রিসার্চের সদস্য। ড. মোয়াজ্জেম পরপর দুবার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য হয়েছেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি; যিনি পরপর দু'বার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন কমিটিরও অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। অ্যাকাউন্টিং ও বিজনেসের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে ও কনফারেন্সে ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের ৩০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে মারডক বিশ্ববিদ্যালয় বিজনেস স্কুলের রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান। করপোরেট অর্গানাইজেশনের সোশ্যাল ও এনভায়রনমেন্টাল রেসপনসিবিলিটি এবং গভর্ন্যান্স তার গবেষণার বিষয়। তিনি রিসার্চ স্টুডেন্টদের সুপারভাইজার হিসেবেও জনপ্রিয়। বর্তমানে তার অধীনে দুই ছাত্র পিএইচডি করছেন।
ব্যস্ততার ডানা
বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সাসটেইনেবিলিটি অ্যাকাউন্টিং ও গভর্ন্যান্স'-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের খুবই জনপ্রিয় শিক্ষক। মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে ড. মোয়াজ্জেম হোসেন কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ও এডিথ কোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে খ কালীন অধ্যাপনা করেছেন। ২০০৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের হিউম্যানিটিস ডিপার্টমেন্ট ও ঢাকা সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন পেশাদার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করছেন। এ ছাড়া সার্টিফায়েড প্র্যাকটিসিং অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা সিপিএ, সার্টিফায়েড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা সিএমএ, মেম্বার অব ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব অস্ট্রেলিয়া বা এমআইপিএ এবং অ্যাসোসিয়েট অব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা এএফএ হিসেবেও কাজ করেন।
অনুপ্রেরণার নাম মোয়াজ্জেম
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মোয়াজ্জেম হোসেন নিজেকে নতুন উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। তার এই অর্জনে আনন্দের বন্যা বইছে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে। একই সঙ্গে মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার সাফল্যে নতুন করে অনুপ্রেরণা পাবে লাল-সবুজের তরুণরা। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে নিজের যোগ্যতায়।
সূত্র- দৈনিক সমকাল
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন