সাত বছরের শিশু সায়মা। তাকে সম্প্রতি ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাটা সারা বাংলাদেশকে বিরাট একটা ধাক্কা দিয়েছে। অসংখ্য বাবা-মা সায়মার জায়গায় নিজের শিশু সন্তানকে কল্পনা করে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবল দুঃশ্চিন্তার ভুগছেন। চারিদিকে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের দাবি উঠেছে।
সত্যি বলছি, ঘটনাটা আমাকে তেমন আলোড়িত করেনি। অনেক মানুষের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে শিশু ধর্ষণ তাদের কাছে একটা নতুন ঘটনা। যেন এর আগে শিশু ধর্ষণের হার কম ছিল তাই সচেতনতার প্রয়োজন ছিল না, এখন ক্রমাগত বাড়ছে তাই সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। মানুষের এই অভিব্যক্তিগুলো, তাদের না জানাগুলোই বরং আমাকে বেশি অবাক করেছে।
আমরা ভুলে গেছি যে আমরা সেই দেশের মানুষ যে দেশে মাত্র দুই প্রজন্ম আগেও কিশোরী বয়সে প্রতিটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যেত। আমাদের দাদি-নানির বয়সী একজনও কি আছেন যিনি আঠারো হওয়ার আগেই সন্তানের মা হননি? একটি ১২/১৩ বছর বয়সী কন্যা শিশুকে বিবাহিত জীবনযাপনে বাধ্য করা কি এক প্রকার শিশু ধর্ষণ নয়? তারও আগে ছয়/সাত বছর বয়সে কন্যা শিশুদের বিয়ে হওয়ার যে রেওয়াজ ছিল সে বিষয়ে আর নাই বা বললাম। তাই আমার মতে শিশু ধর্ষণ আমাদের সমাজে কোন নতুন কনসেপ্ট নয়। যুগ যুগ ধরে এদেশে কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা ছিল। তারা ধর্ষিতও হোত। সেই অন্যায়ের রূপ সময়ের সাথে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র।
সেই কতদিন আগের কথা। কিন্তু এখনো বখাটেদের হাত থেকে বাঁচতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মারা যাওয়া তৃষার মৃত্যু আমার বুকে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। বছরের পর বছর ধরে আমাদের সমাজে বখাটেরা কন্যা শিশুদের নানাভাবে উত্যক্ত করে আসছে। কখনো কখনো তা শ্লীলতাহানী বা ধর্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। একটি প্রান্তিক গ্রামে গিয়ে একজন দরিদ্র পিতাকে জিজ্ঞেস করুন, কেন আপনার মেয়েকে অল্পবয়সে বিয়ে দিচ্ছেন? তিনি যদি বলেন, আমার পক্ষে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় - তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। শৈশবে কারণে-অকারণে আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী পুরুষরা শরীর হাতড়ায়নি এমন অভিজ্ঞতাহীন নারী কি বাংলাদেশে সত্যিই আছে? এ ধরনের অভিজ্ঞতা অনেক ছেলেরও হয়েছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, তাদের শৈশবকালে এভাবে শিশুরা টার্গেটেড হতো না। খুবই ভুল কথা। সেই শিশুরা জানতোই না খারাপ স্পর্শ কী, শরীরে কেউ অশালীনভাবে হাত দিলে কী করতে হয়। তাদের বাবা-মা তাদের সেটা শেখাননি। তাই তারা তাদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়গুলো গোপন করে আড়ালে চোখের জল ফেলেছে।
অথচ সায়মার ঘটনায় চারপাশের মানুষ এমনভাবে নড়েচড়ে বসেছে যেন শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তা তারা প্রথম শুনলেন। হয়ত কেউ কেউ ভাবছেন- হালকা অভিজ্ঞতাতো সব মেয়েরই শৈশবে কমবেশি হয়, তাই বলে মেরেই ফেলবে? আরও ভাবছেন, এত ছোট শিশুর প্রতি কেউ খারাপ দৃষ্টি দেয়? বলি, আপনার শিশু সন্তানকে কোলে বসিয়ে আদরের ছলে চুমো দেয়ার আর চিপাচিপি করার অনুমতি যে আপনি সবাইকে দিয়ে রেখেছেন, কার মনে কী আছে ভালোভাবে সেই খোঁজ নিয়েছেনতো?
তবে সবচেয়ে সাংঘাতিক হলো সায়মার ঘটনার পর শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বাবা-মায়েদের বেছে নেওয়া পদ্ধতিগুলো। কেউ বলছেন, সন্তানকে খেলতে যেতে দিতে ভয় লাগে। আবার কেউ বলছেন, এখন থেকে আর শিশু সন্তানকে একা সিঁড়িতে বা লিফটে উঠতে দেবেন না। চারপাশে শুধু ভয় আর ভয়। সবাই সন্তানকে প্রোটেক্ট করে রাখতে চায়। সবাই ভুলে গেছে যে, ওভারপ্রোটেকশনের ফলাফল কখনোই ভালো হয় না। এটা শিশুদের ভীতু মানুষে পরিণত করে, তার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দেয় কারণ তার সঙ্গে কোন অন্যায় হলে বা কেউ অশালীন আচরণ করলে সে প্রতিবাদ করতে পারে না।
এসব ঘটনা থেকে এটাই আমার মনে হচ্ছে যে অামরা যেন ধরেই নিয়েছি শিশুর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ এসব ঠেকানো সরকারের কাজ। আমার শিশুকে আমি নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখতে পারলেই চলবে। এই ধরণের স্বার্থপর এবং ভীতু টাইপ চিন্তাধারাগুলোই সমস্যাটিকে কমানোর বদলে আরও প্রকট করে তুলছে। তারচেয়ে বরং আসুন আমাদের পুত্র-কন্যাদের মেরুদন্ড সোজা করে বড় হতে শেখাই। তাদের ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শের ধারনা দেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কী করতে হবে তা বুঝিয়ে বলি। আসুন সন্তানের বন্ধু হই যেন সে যেকোন বিষয় নির্ভয়ে আমার কাছে বলতে পারে। আপনার আশেপাশে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেই শিশু যৌননিপীড়নকারী লুকিয়ে থাকে। শিশুকে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না করে এইসব নোংরা মানসিকতার লোকগুলোকে চিহ্নিত করতে শিখুন। তাদের কাছ থেকে সন্তানকে নিরাপদে রাখুন।
সবচেয়ে বড় কথা হোল, আপনার কন্যাকে শেখান এবং নিজেও বিশ্বাস করুন শরীর একজন মানুষের জীবনে সব কিছু নয়। ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানীতে কেউ নষ্ট হয়ে যায় না। ক্ষতগুলো আসলে তৈরি হয় মনের ভেতর। আর যে নারী যত আত্মবিশ্বাসী হয়ে বড় হবে তত দ্রুত সে মনের ক্ষত সামলে উঠার, অপরাধীর বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যাওয়ার সাহস পাবে। আর আপনি যদি পুত্র সন্তানের পিতামাতা হোন সেক্ষেত্রে প্রথমে নিজের মনকে পুরুষতান্ত্রিকতা মুক্ত করুন। তারপর পুত্রকে পুরুষ মানুষ নয় বরং মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন।
শহরে পাগলা কুকুরের উৎপাত ঘটলে দরজা বন্ধ করে রেখে ঘরে বসে থাকা কোন সমাধান নয়। পাগলা কুকুরকে বধ করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হয়। ঠিক একইভাবে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখা বা সারাক্ষণ নজরদারি করা কোন কার্যকর সমাধান নয়। সরকারের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেও চলবে না। তাই আসুন শিশুদের জন্য সহিংসতা এবং ধর্ষণমুক্ত শৈশব নিশ্চিত করতে আমরা কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি সে বিষয়ে আরও বেশি করে আলোচনা করি। নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হোক প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ মাতৃভূমি। সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করার এখনই সঠিক সময়।
উপমা মাহবুব: উন্নয়ন পেশাজীবি ও কলাম লেখক
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন