বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বিউটি আর সেলফ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি বা কমিউনিটি’ কনসেপ্টটা একেবারেই নতুন। কিছুদিন আগেও মানুষ সেলফ কেয়ার বলতে মাসে একবার পার্লার বা স্যালনে যাওয়াটাই বুঝত। আর তারুণ্য পেড়িয়ে গেলে সেটুকুও বাঁকা চোখে দেখে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে কারো আটকাতো না। ‘সেলফ কেয়ার’ নিয়ে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে আপাদমস্তক পাল্টে ফেলেছে যারা তারাই ‘সাজগোজ’। কথা হয় সাজগোজের সহ প্রতিষ্ঠাতা ‘সিনথিয়া রিমি’-র সঙ্গে।
ক্যারিয়ারের শুরু কীভাবে?
সিনথিয়া রিমি: ট্রেইনড অ্যান্ড প্রাকটিসিং ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের শুরু। সাজগোজের আগে নাইজেরিয়ায় বেশ বড় একটা ফার্মাসিতে কর্মরত ছিলাম। অনেক আগের কথা। ২০০৯ সালে বিয়ে। তারপর ২০১০ সালে থেকেই প্র্যাকটিস! সাধারণ ৯টা থেকে ৫টা কাজের মতোই ছিল।
ফার্মাসিস্ট থেকে উদ্যোক্তা?
সিনথিয়া রিমি: লম্বা গল্প। অনেক কথা। আসলে আমি যখন ফার্মাসিস্ট হিসেবে বসতাম মানুষ আমার কাছে সাধারণ প্রেসক্রিপশন নিয়ে হেল্প চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক, চুল, স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও জানতে চাইত। অনেক কিছু আমি নিজেই জানতাম না তখন। কিভাবে জানব বলুন, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, নিজের যত্নের কথা নিজেরও ওভাবে মনে হয়নি কখনো। পেসেন্টকে হেল্প করার জন্য আস্তে আস্তে চুল, ত্বকের সমস্যা নিয়ে জানতে শুরু করলাম। যখন দেখতাম আমার সাজেস্ট করা একটা প্রোডাক্ট বা টিপসে পেসেন্টরে উপকার হচ্ছে। সে ক’দিন পর এসে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, কি যে ভালো লাগত। বলতে গেলে এই ভাললাগা, মানুষের কাজে আসতে পারার ফিলিংসটা থেকেই সেলফ কেয়ারের ওয়ান স্টপ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সাজগোজের শুরু।
সাজগোজ লাইফস্টাইল বেজড প্ল্যাটফর্মই কেন?
সিনথিয়া রিমি: আসলে ২০১৩ সালের দিকে আমি দেশে ফিরে আসি। দীর্ঘদিন মানুষকে সাজেশন দিতে দিতে মনে হয়েছিল। দেশে কেন আমার এমন কোনো আস্থার একটা প্ল্যাটফর্ম নেই? যেখানে আমি ডেইলি লাইফের সব টপিকে হেল্প পাব? এর পর দেখলাম আমার আত্মীয়দের সঙ্গে গল্প করার সময় কোনো টপিকে হেল্প চাইলে সবাই কিছু না কিছু টিপস আমাকে দিচ্ছে। অনেক সময় অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্বের শুরুও হত একটা প্রশ্ন দিয়ে, যেমন- ‘আপু আপনার হেয়ার কালারটা সুন্দর, কোত্থেকে করিয়েছেন?’ তখনই ভাবলাম, আমাদের মানুষ অনেক জানে, অন্যকে হেল্প করতেও চায়। একটা শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মেরই অভাব! মাথায় নতুন ধরনের কিছু করার আইডিয়া আসে।
ওয়েবসাইটে ইউনিক কনটেন্ট কীভাবে করলেন?
সিনথিয়া রিমি: শুরুর দিকে আমরা, মানে সাজগোজের প্রতিষ্ঠাটারাই সব আর্টিকেল লিখতাম সঙ্গে আমাদের ফেসবুক পেজে পাঠকদের ইনবক্সে হেল্প করতাম। এভাবে প্রায় ১ বছর পার হল। কিন্তু ২০১৩-২০১৪ সালে ফেসবুক বাংলাদেশে খুব পপুলার হয়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেজের ফলোয়ারও অনেক বেড়ে যায়। মনে আছে, ২০১৩ সালে ৩০ হাজার লাইক থেকে ২০১৪ সালে ৫ লাখের মত লাইকে উঠেছিল আমাদের ছোট পেজ! ২০১৮ সালে ১৩ লাখের বেশি। আর এগুলো সবই অর্গানিক ফলোয়ার। বুঝতেই পারছেন প্রেসার কত বেড়ে গেছে! ওই গ্রোথের সঙ্গে তাল রেখে পাঠকদের সাহায্য করতে গিয়েই আমরা সাজগোজ ওয়েবসাইটে আলাদা এডিটর নিয়োগ দেই, ফ্রিল্যান্সার লেখক নিয়োগ দেই প্রচুর, ইনবক্স হ্যান্ডল করতে টিম তৈরি করা হয়। টার্গেট ছিল, যেন আমাদের কোনো পাঠক হেল্প চেয়ে খালি হাতে ফেরত না যায়। কষ্ট হয়েছে, এর ভেতরে নিজের পরিবারের সদস্য বেড়েছে। সবমিলিয়ে ফ্যামিলির সহযোগিতায় উৎসে গেছি। সাজগোজের সার্ভিসের কোয়ালিটিও বজায় রেখেছি।
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ে কাজ করা কি জটিল না?
সিনথিয়া রিমি: আমরা যখন শুরু করেছি তখন ফেসবুক খুব প্রিভিলেজড কিছু মানুষই ইউজ করত। কিন্তু আমরা জানতাম বিশাল পরিবর্তন আসছে সামনেই। ডিজিটাল মিডিয়াই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই আদাজল খেয়ে লেগে থেকেছি। ধীরে ধীরে টেলিকমিউনিকেশন উন্নত হয়েছে, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। ভাবা যায়, একি সঙ্গে আমরা তেঁতুলিয়ার গ্রামের এক গৃহবধূকে হেল্প করছি আবার সঙ্গেই এক আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিকে হেল্প করছি! ডিজিটাল মিডিয়া শুরুতে জটিল ছিল, কিছুদিন নিজেদের কাঁটা ঘুড়ির মত উদ্দেশ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের সাবস্ক্রাইবারদের সাপোর্ট দেখে কাজটা আগের মত জটিল লাগে না। অনেকটা যেন বুঝে উঠছি।
কম সময়ে বড় সাফল্যের রহস্য কি?
সিনথিয়া রিমি: আমাদের সাফল্য পরিমাপ করা হচ্ছে আসলে আমাদের রিডার, ফলোয়ারের সংখ্যা দিয়ে। কিন্তু আমার টিপিকাল ডেস্ক জবের দিনগুলো থেকেও ‘আমার টিপসে কার কতটুকু হেল্প হল’ সেটা দিয়েই নিজের সাফল্য মেপেছি, এখনো আমরা সেভাবেই নিজেদের সাফল্য মাপতে চাই। যদি সম্ভব হয় আরকি! কিন্তু হ্যাঁ, মানুষের এত ভালবাসা পাবো এটা কখনো ভাবিনি। ১৩ লাখ মানুষ রোজ আমাদের পোস্ট, রিভিউ দেখছে। দরকারি তথ্য পাচ্ছে, এইতো অনেক।
সোশ্যাল মিডিয়া সঙ্গে গতানুগতিক প্রফেশনাল লাইফ কীভাবে?
সিনথিয়া রিমি: হয়তো দুটো একেবারেই আলাদা! কিন্তু আমার জন্য লিঙ্ক ছিল আমার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড। সাজগোজে মানুষ যখন বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে কনফিউজড হয়ে হেল্প চাইত তখন আমি খুব সহজেই আমার নলেজ ইউজ করেই প্রোপার ইনফরমেশনটা তাকে দিতে পারতাম। সো ফার্মাসিস্ট হিসেবে যা করতাম মোটামুটি তার কাছাকাছি একটা কাজই আমি করছি। জাস্ট আগে ফেস টু ফেস কমিউনিকেশন করতাম, এখন অনলাইনে করছি।
সেলফকেয়ার নিয়ে কি হেল্পফুল কনটেন্ট তৈরি করে ‘সাজগোজ’?
সিনথিয়া রিমি: যখন অনুভব করলাম মানুষ ‘সাজগোজ’ শব্দটাকেই কতটা নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখে। এ ছাড়া ‘সাজগোজ’ শুনলেই মানুষভাবে, মেয়েলি একটা ব্যাপার, অভিয়াসলি এখানে ‘মেয়েলি’ শব্দটাও নেগেটিভলি ইউজ করা হয়। ছেলেরা তাই দরকার হলেও মুখ ফুটে প্রশ্ন করে না, আবার একটু প্রফেশনাল, ক্যারিয়ার অরিয়েন্টেড মেয়েরাও মেকআপ, রূপচর্চা করলে মানুষ তাদের ‘সিরিয়াসলি’ নেবে না ভেবে নিজেকে অবহেলা করে করে ‘কিছু একটা’ প্রমাণ করতে চায়। যেন ‘মেয়েলি’ না হওয়াটা বিশাল একটা গর্বের বিষয়। সঙ্গে সঙ্গে একটু পরিপাটি মানুষকে টিটকিরির অভ্যাসটাতো আছেই। কেন এমন চিন্তা? নিজেকে নিয়ে ভাবাটা কি খারাপ? না পাপ? নিজেকে যে ভেতর বাহির থেকে ইম্প্রুভ করতে চায় না, সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রেজেন্ট করতে চায় না, সে নিজের আশেপাশের মানুষ, সমাজ, ক্যারিয়ারে কেমন প্রভাব ফেলবে? অনেকটা জেদ করেই নিজেদের ‘সাজগোজ’ বলা। সাজগোজ এখানে একজন মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে বোঝাচ্ছে, বয়স, লিঙ্গ, আবাস ভেদে সব বাংলা ভাষাভাষীরা যেন নিজের ডেইলি লাইফের যেকোনো সেক্টরে হেল্প দরকার হলে পায় এবং নিজের জীবনের মান উন্নত করতে পারে এটা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ।
বিজনেস ব্যাপারটা স্ট্রেসফুল লাগে না?
সিনথিয়া রিমি: এখন আমার দুই সন্তান, আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ দুজন একই অফিসে কাজ করি। বাচ্চাদের রেস্পনসিবিলিটি ভাগাভাগি করে নেই। আবার বাচারাও খুব সাপোর্ট দেয়। এমন সাপোর্ট পেলে সারাদিন কাজ করে যেতেও ক্লান্ত লাগে না। আর নিজের ভালোলাগার সেক্টরে কাজ করে যে মজাটা পাচ্ছি সেটা আমি হয়ত কখনই ডেস্ক জবে পেতাম না। ভেতরে ভেতরে অর্ধমৃত হয়ে যেতাম। ক’জন নিজের পছন্দের কাজটা করার চান্স পায় বলুন? সেদিক থেকে আমি লাকি। সো নো কমপ্লেইন!
ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আপনার মন্তব্য?
সিনথিয়া রিমি: একেবারেই শৈশবে আছে। এখনো অনেকেই অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে। যে পথে আছে সেটা রাইট না রঙ? বোঝার উপায় নেই। কিন্তু অনেক তরুণরা আসছে, রিস্ক নিচ্ছে, পরিশ্রম করছে। দেখতে দেখতে অনলাইন বেজড অনেক ভালো ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটির সার্ভিস বেজড মার্কেটপ্লেস আসছে! এখন আমি খুবই আশাবাদি। ভবিষ্যতে খুব বড় পরিবর্তন আসবে, আর সেটা পজিটিভই হবে।
টিমওয়ার্ক ও টিম সম্পর্কে বলুন।
সিনথিয়া রিমি: আমাদের সঙ্গে প্রায় ৮০ জন ফ্রিল্যান্সার রাইটার, রিভিউয়ার কাজ করেন। এ ছাড়াও ইনহাউজ প্রায় ৬০ জনের মত এডিটর, ভিডিও প্রডিউসার, এসইও স্পেশালিস্ট আছেন। আমরা সবাই চেষ্টা করি আমাদের বেস্টটা দিয়ে অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরি করতে। আর ধীরে ধীরে নিজেদের কাজের কোয়ালিটি আমরা আরো উন্নত করছি। সঙ্গে নতুন নতুন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করছি। আশা করি ফিউচারে সাজগোজ থেকে আরো ভালো কাজ পাবেন।
টিম মেম্বারদের কোন কোয়ালিটি প্রাধান্য দেন?
সিনথিয়া রিমি: আমাদের টিম মেম্বার নির্বাচনের প্রধান ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে ‘হেল্পফুল’ মেনটালিটি। নিজেকে নিজের স্কিলসেটকে আরও উন্নত করার চেষ্টা থাকতে হবে। আমিও রোজ রোজ নতুন জিনিস শিখি জানি, আমার টিমও যেন সেভাবেই প্রতিটা দিনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারে এনভায়রনমেন্ট আমি সাজগোজে ক্রিয়েট করতে চাই।
ভবিষ্যতে সাজগোজ এবং নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
সিনথিয়া রিমি: আমাদের বর্তমান চিন্তা হচ্ছে কিভাবে মানুষের হাতে সবচেয়ে কম দামে অরিজিনাল প্রোডাক্ট পৌঁছে দেয়া যায় সেটা। অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছি, মধ্যবিত্ত মানুষ নিজের জন্য একটা ভালো জিনিস কিনতে খুব কষ্ট করে টাকা জমায়, সেটা সে খরচও করতে চায়। কিন্তু বাঁধ সাধে আমাদের দেশে অরিজিনাল প্রোডাক্টের অপ্রতুলতা আর নকলের রাজত্ব। সত্যিই যখন দেখি মফস্বলের এক ছাত্র নিজের টিউশনির টাকায় খুব বড় কোন বিজনেসম্যানের কাছ থেকে নকল একটা প্রোডাক্ট কিনে নিজের হেলথের সিরিয়াস ক্ষতি করে ফেলেছে তখন অসম্ভব কষ্ট হয়। ভবিষ্যতে সাজগোজকে একটা বিশ্বাসের জায়গায় রুপান্তরিত করতে চাই, যেখানে সমাজের যে কোনো স্তরের মানুষ দরকারি সাহায্য পাবে, দরকার হলে চোখ বুঝে ১০০% অরিজিনাল যে কোনো বাজেটের প্রোডাক্ট পাবে। সব টপিকে আমরা টিউটোরিয়াল তৈরি করতে চাই, যেন ঘরে বসেই মানুষ নিজের দরকারি কাজটা নিজেই করে নিতে পারে। আমাদের সাবস্ক্রাইবারদের স্বাবলম্বী হতেও হেল্প করতে চাই। মোট কথা, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন সাজগোজ থেকে হেল্প পায়। ড্রামাটিক শুনতে লাগছে? আমি কিন্তু এটাই চাই, সো বুঝতেই পাড়ছেন কতটা কাজ বাকি! মাত্রতো পথচলা শুরু হলো।
সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন