রাস্তার পাশে হটডগ বেচতেন ফিলিক্স শেলবার্গ। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন ভিডিও গেম খেলে আয়-রোজগারের আশায়। ফলে ছেলেকে নিয়ে কপাল চাপড়াতে বসেছিলেন মা-বাবা। কিন্তু এখন ইউটিউবে ফিলিক্সের চ্যানেল পিউডিপাইয়ের অনুসারী ১০ কোটি। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ডলার। সুইডিশ এই তরুণ অল্প বয়সে এমন বাজিমাত করলেন কী করে? জানাচ্ছেন মাহফুজ রহমান
বিয়ের আগে পাত্র সম্পর্কে একটি চিরচেনা দেশি প্রশ্ন হলো, ‘পাত্র কী করে?’ ১৯ আগস্ট বিয়ে করলেন ফিলিক্স শেলবার্গ। বাংলাদেশি হলে বিয়ের কথাবার্তার শুরুতে পাত্রীপক্ষ নিশ্চয়ই একই প্রশ্ন তুলত। সে ক্ষেত্রে উত্তর হতো, ‘পাত্র ভিডিও গেম খেলে।’ পাত্রীপক্ষের প্রযুক্তিজ্ঞান শূন্য হলে ফিলিক্সের ৮ বছরের প্রেমের কী পরিণতি হতো একবার ভাবুন! যাহোক, ফিলিক্স শেলবার্গের কাজই হলো ভিডিও গেম খেলা এবং তা ভিডিও করে ধারাবিবরণীসহ ইউটিউবে প্রকাশ করা। তাঁর ভিডিওগুলো যেন একেকটি তাজা মুরগি আর দর্শক যেন ক্ষুধার্ত পিরানহা মাছের ঝাঁক। মুরগি পানিতে পড়তে না-পড়তেই পিরানহার দল যেমন হাপিশ করে দেয়, ফিলিক্সের ভিডিওগুলো তেমনই। প্রকাশ হতে না-হতেই কোটি কোটি ভিউ। পার্থক্য একটাই, মুরগি ফুরিয়ে যায়, পিউডিপাইয়ের ভিডিও থেকে যায় বহাল তবিয়তে। দিন যায় ভিউ বাড়ে। পিউডিপাইয়ের প্রায় চার হাজার ভিডিও এ পর্যন্ত মানুষ দেখেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি বারের বেশি! এই ভিউয়ের সঙ্গে ফিলিক্সের আয়ও বাড়ে সমান তালে। দিনে তাঁর ব্যাংকে জমা হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। কদিন আগেও ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি অনুসারী ছিল পিউডিপাইয়ের। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টি-সিরিজ সে জায়গা দখল করে বসেছে। তবে ব্যক্তির অনুসারীর তালিকায় ফিলিক্স ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৪ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী নিয়ে এ তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন জাস্টিন বিবার।
ফিলিক্সের পাগলা ভাইয়েরা
গত বছরের নভেম্বরের কথা। ইউটিউবে এগিয়ে থাকার রেসে পিউডিপাইয়ের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছিল টি-সিরিজ। সে সময় সারা বিশ্বের কিশোর-তরুণ পিউডিপাইয়ের ভক্তরা রীতিমতো পাগল হয়ে গেলেন। খোদ বাংলাদেশে এক দল কিশোর-তরুণ পোস্টার সেঁটে দিলেন দেয়ালে আর গাছে! হাতে তুলে নিলেন প্ল্যাকার্ড। বিলি করলেন প্রচারপত্র। তাতে লেখা, ‘পিউডিপাইকে সাবস্ক্রাইব করো!’ কেন? টি-সিরিজকে পেছনে ফেলতে হবে। ফিলিক্স তাঁর এই ভক্তদের নাম দিয়েছেন ব্রোজ। ভারতীয় এক ভক্ত তো বিলবোর্ড পর্যন্ত ভাড়া করে বসেছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, ‘ইউটিউবের দোহাই, পিউডিপাই চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে ইউটিউবকে রক্ষা করুন।’ ব্যক্তি উদ্যোগে একই ধরনের বার্তা প্রচার করা হয় মার্কিন মুলুকের টিভিতে। পাগলামি একসময় উন্মাদনায় গিয়ে ঠেকে। ফিলিক্সের ‘পাগলা ভাইয়েরা’ সারা বিশ্বের এক লাখের বেশি প্রিন্টার হ্যাক করে ফেলেন! মানুষকে বাধ্য করেন পিউডিপাইয়ের পক্ষে পোস্টার ছাপাতে। ফলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সে কি গলদঘর্ম দশা!
আরেক সফল ড্রপআউট
ফিলিক্স শেলবার্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘অনেকেই আমাকে বলে, “গেম খেলা তোমার কাজ? তুমি এই করেই রোজগার করো? অদ্ভুত!”’ ফিলিক্স পাল্টা জবাবে বলেন, ‘আপনি যখন বিষয়টি বুঝবেন, আমাকে আরও জানবেন, তখন উপলব্ধি করবেন আসলে কাজটি কতটা কঠিন। এবং খুব বেশি মানুষ এমনটা করে দেখাতে পারে না। মনে রাখতে হবে, আমার অনুসারী বিলিয়ন বিলিয়ন। এটাই তো অনেক কিছু বলে দেয়।’
কথা সত্য। ভিডিও গেম যে একটা মানুষের রুটিরুজির পথ হতে পারে, তা-ই–বা কে ভেবেছিল! শুরুতে ফিলিক্স নিজেও কি তা ভেবেছিলেন? সুইডেনের গোটেনবার্গে জন্ম ১৯৮৯ সালে। মা-বাবা দুজনই ছিলেন উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী। ছেলেবেলায় আঁকাআঁকি আর ভিডিও গেমই ছিল ধ্যানজ্ঞান। ভিডিও গেম খেলার জন্য স্কুল পালাতেন হরহামেশা। স্কুলের একদম শেষদিকে ফল অবশ্য ভালোই করেছিলেন। তাই ২০১০ সালে সুইডেনের চালমার্স ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস অ্যান্ড টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে। একই বছরে ইউটিউবে খোলেন পিউডিপাই চ্যানেলটি। পরের বছরই বিশ্ববিদ্যালয়কে জানান ‘টা টা বাই বাই’। কিন্তু ভিডিও তৈরি করতে হলেও তো কিছু টাকাপয়সা দরকার। তাই নিজের আঁকা ছবি আর হটডগ বেঁচে একটা উপায় খুঁজতে লাগলেন। নিজের আয়ে একসময় একটি কম্পিউটারও কিনে ফেলেন ফিলিক্স। সেটি দিয়ে শুরু করেন ভিডিও সম্পাদনার কাজ। ২০১২ সালে ইউটিউবে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা পেরিয়ে যায় ১০ লাখের মাইলফলক। পরের বছরই ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি অনুসারীওয়ালা চ্যানেলের মালিক বনে যান ফিলিক্স। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই চ্যানেলই বেশি দেখেছে বিশ্বের মানুষ।
নতুন দিনের তারকা
পিউডিপাই চ্যানেলটির প্রধান আকর্ষণ হলো ‘লেটস প্লে’। মানে ফিলিক্সের গেম খেলার ভিডিওগুলো। ভিডিও গেমের মধ্যে মাইনক্রাফট তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। হরর গেমগুলো খেলার সময় তো ভীষণ চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দেন। তাই পিউডিপাইয়ের ভিডিও দেখার সময় ইয়ারফোনের ভলিউম কমিয়ে রাখাই উত্তম। ফিলিক্স অবশ্য এখন হাসি-তামাশার ভিডিও চিত্রও নির্মাণ করছেন। সেসবের বেশ কাটতি, সমালোচনার কমতিও নেই। বর্ণবাদী মন্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন একাধিকবার। আবার সুনাম কুড়িয়েছেন দাতব্য কাজে অংশ নিয়ে। জনহিতকর কাজে ভক্তদের উৎসাহিত করার জন্য পেয়েছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা। ২০১৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০০ প্রভাব বিস্তারকারী মানুষের তালিকায় ফিলিক্স শেলবার্গের নামটিও রেখেছিল।
আগেই জেনেছেন, ৮ বছর প্রেমের সাগরে ভেসে ফিলিক্স শেলবার্গ থিতু হয়েছেন। তাঁর ইতালীয় স্ত্রী মারজিয়াও ছিলেন ইউটিউবার। দুজন এখন থাকেন যুক্তরাজ্যের ব্রাইটনে। ২০১৮ সালে দুজন মিলে সুকি নামের পোশাকের ব্র্যান্ড খুলে সুখেই আছেন। বিশ্বের বাঘা বাঘা সংবাদমাধ্যম তাঁদের ওপর নজর রাখতে শুরু করেছে, যেমনটা রাখে আর দশটা হলিউডি তারকার ওপর। ইউটিউব যে বিনোদনজগতে বিশাল পরিবর্তন এনেছে এবং তারকার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে, ফিলিক্স তার বড় প্রমাণ। ২০১৫ সালে দিজ বুক লাভস ইউ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন এই তারকা। মানুষ হুমড়ি খেয়ে সে বই কিনেছে। বই প্রকাশের দুদিন আগে থেকে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের বার্নস অ্যান্ড নোবেল নামের বইয়ের দোকানের এক কর্মীর ভাষায়, ‘আল গোরের নির্বাচনী প্রচারণাতেও এত মানুষ দেখিনি!’
এসবে অবশ্য ফিলিক্স শেলবার্গের তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না। তাঁর কথা, ‘আমি এই পর্যায়ে না এলেও এই কাজই করতাম। শুরুতে কল্পনাও করিনি এত দূর আসব। ইউটিউবের মজাটাই এখানে, যে কেউ কিছু একটা করে ফেলতে পারে।’
সত্যিই, ‘পৃথিবী বদলে গেছে…!’
সূত্র: বিবিসি ও রোলিংস্টোন
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন