টেবিল নম্বর-২১, এটা একটি মুভি। হয়তো অনেকে দেখেছেন বা অনেকে শুনেছেন। কিন্তু কে কিভাবে নিয়েছেন তা জানিনা। যে যেভাবে নিয়ে থাকুন না কেন। আমি কিন্তু অন্যভাবে নিয়েছি। মূলত মুভিটার মুল ম্যাসেজ ছিল- not a joke, it is a crime.
এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাশ করে একজন কৃতি শিক্ষার্থী যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় বা ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যায় ঠিক ওই সময়ে র্যাগিংয়ের সব চেয়ে বেশি শিকার হয়। ভর্তি কোচিং কিংবা ভর্তি নামক ভয়ঙ্কর স্টেপগুলো পার করে একজন শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। নতুন ছাত্র হয়ে এসে সে সবার আগে যে জিনিসটার মুখোমুখি হয় সেটা হলো র্যাগিং । আবার অনেক সময় পাড়ায় কোন নতুন ছেলে/মেয়ে আসলে পুরাতনরা তাদের র্যাগিং দেয়।
র্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে “পরিচয় পর্ব” অর্থ্যাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্যতা গড়ে তুলার জন্য যে পরিচিত প্রথা সেটাকে র্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়।
র্যাগিং এর শুরু প্রাচীন গ্রিসে। সেটা শুধু মাত্র বড়দের আর ছোটদের পরিচয় পর্ব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে র্যাগিং এর রূপ পাল্টাতে থাকে। বর্তমানে বড়রা পরিচয় পর্বের নামের গালভরা শব্দের আড়ালে জুনিয়রদের নিয়ে যথেষ্ঠ শারীরিক ও মানোসিক যন্ত্রনা দেয়। সর্বপ্রথম ইংরেজরা এই সংস্কৃতির রচয়িতা। ইংরেজদের মাধ্যমে এই সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ করলেও এর বিবর্তিত রূপটাই আমাদের মধ্য রয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই পড়তে পারে না। একমাত্র মেধাবীরা ছাড়া। তাও ভর্তি পরীক্ষা নামক যুদ্ধে যে টিকে থাকে সেই পড়ার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে র্যাগিং শব্দটা বেশ পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে র্যাগিং অতঃপ্রত ভাবে জড়িত। বাংলাদেশে প্রায় পাবলিক ভার্সিটিতে এবং মেডিকেল কলেজে র্যাগিং হয়ে থাকে। এছাড়া কিছু প্রাইভেট ভার্সিটিতে র্যাগিং হয়। র্যাগিং সম্পর্কে অনেকেরই খারাপ ধারণা থাকলেও আবার কেউ কেউ বিষযটাকে প্রজেটিভ ভাবেন।
র্যাগিং এর কয়েকটা ধরণ রয়েছে। যেমন- পরিচয় দেওয়া, গান গাওয়া, নাচা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি। অনেক সময় রোদ্রে ক্যাম্পাসে দৌঁড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন রয়েছে। র্যাগিং এর মধ্যে সব চেয়ে খারাপটা হচ্ছে সিনিয়র আপুদের ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন হয়ে থাকে।
র্যাগিং কারও কারও জীবনে ইতিহাস হয়ে থাকে। যেমনটা আমার আর আমার বন্ধুর জীবনে হয়ে আছে। র্যাগিং নিয়ে আমার বড় একটা অভিজ্ঞতা আছে। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যাই। পরীক্ষা ভালো ও বেশি প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আমানত হলে উঠি। সাথে আমার এক বন্ধু। পরের দিন পরীক্ষা নেই। তাই দুই বন্ধু মিলে সেই রাতের প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরপর ঘুমাতে যাবো এমন সময় কে যেন বাইরে থেকে দরজা ঠেলছে। আমি খুলে দিলাম। দেখলাম চার বড় ভাই। তারা আমাদের উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করলো। খুব বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম আর ভয় পাচ্ছিলাম। একজন বলল, গান গাইতে জানিস? অন্য একজন বলল, নাচতে জানিস? আমাকে গান গাওয়ার জন্য বলল। আমি বলেছিলাম গান গাইতে জানিনা। সে জন্য আমাকে ১০ বার কান ধরে উঠতে বসতে বলা হয়েছিলো। এই ভয়ে একটা গানের দুলাইন গেয়েও শাস্তি পেতে হয়েছিলো। আমার বন্ধু নাচতে জানে না। নাচ না জানার অপরাধে তার শাস্তি হয়ে ছিল শরীরের জামা কাপড় খুলে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে আমি ওঠার আগে আমার বন্ধু আমাকে না বলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পরীক্ষা না দিয়ে পালিয়ে গেছে। তার অনেক স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার। গরীব ঘরের সন্তান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সামর্থ নেই। সেই দিন রাতের র্যাগিং এর কারণে তার স্বপ্ন সে পুরন করতে পারেনি।
মনে আছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া চার শিক্ষার্থীর কথা। র্যাগ দেওয়া ডাস্টবিন থেকে পঁচা খাবার খাইয়ে, পরবর্তীতে ঐ শিক্ষার্থীরা এটার বিরোধীতা করলে তাদেরকে অর্ধনগ্ন করে এক পায়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
অনেক সময় আমরা দেখে থাকি। অমুক অনেক ভালো শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু সে কলেজে ওঠে পড়া লেখায় অমনোযুগী হয়ে পড়েছে। পরীক্ষায় ফেল করেছে। অথবা আমরা দেখে থাকি সে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। কোথাও পালিয়ে গিয়েছে। অনেক সময় আমরা এও দেখতে ও শুনতে পায় সে আত্মহত্যার পর্যায়েও চলে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী র্যাগিং এর কারণে আত্মহত্যা করে।
তবে বাংলাদেশে র্যাগিং এর ঘটনা ঘটে সব চেয়ে বেশি জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী র্যাগিং এর কারণে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্ত্বীর্ণ হয়েও অনেক শিক্ষার্থী পালিয়ে যায়।
আবার অনেকে এটাকে ট্রাডিশন মনে করেন। মূলতঃ এটা একটা নির্যাতনের চলমান আধুনিক প্রক্রিয়া। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তার সিনিয়র ব্যাচ এর কাছ থেকে এটার শিকার হয় এবং নিজেরাও একি মানসিকতায় পরিণত হয়। সেই কলেজ জীবন থেকে আমি দেখেছি কেন শিক্ষার্থীরা র্যাগিংয়ের শিকার সব চেয়ে বেশি হয়? রাজনীতি। কোন ছাত্র যদি ক্ষমতাশীল দলের বাইরে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত কিংবা বিরুদ্ধে মতামত পেশ করে তাহলে এই র্যাগিং নামের নির্যাতন চালানো হয়। যাতে র্যাগিংয়ের ভয়ে দল ত্যাগ করে কিংবা পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় এই বিষয়টির উপর গভীর লক্ষ রাখা উচিত। র্যাগিং একটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এই অপরাধ বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রনয়ন করা উচিত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিং বিষয়ে চিন্তা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের এর হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। কারণ এটি অনেক সময় গুরুতর ক্রাইম এর পর্যায় চলে যায়। অনেকের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পড়া লেখায় অমনোযোগী হয়ে যায়। বিভিন্ন খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকে রেগ খেয়ে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার একটি ভাসনা থেকে যায়। যা এক সময় বড় ধরণের অপরাধে পরিণত হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন