ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার একটি পরীক্ষা হলো আইইএলটিএস। স্পিকিং, লিসেনিং, রাইটিং ও রিডিং—এই চার অংশ মিলিয়ে ৯-এর মধ্যে ৭.৫ পেলেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী সন্তুষ্ট হন। সেখানে কাজী মুস্তাবীন নূর পেয়েছেন ৯–এ ৯! কীভাবে? সেটাই লিখেছেন তিনি।
ফ্রক পরা ছোট্ট এক মেয়ে ও তার শৌখিন বাবার গল্প শুনুন। মেয়ের বয়স যখন মাত্র কয়েক মাস, তার ‘পাপা’ ঘটাল এক কাণ্ড। রেলস্টেশনের বইয়ের দোকানে পেয়ে গেল কিছু ইংরেজি ক্ল্যাসিক বইয়ের সংক্ষেপিত, ছবিওয়ালা বই; ব্যস, বাড়ি নিয়ে চলল। ওইটুকুন মেয়ে কি শার্লক হোমস, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বা গ্রেট এক্সপেকটেশনস পড়তে পারবে? ছবি দেখেও কি কিছু বুঝবে? পাপা বলল, ‘বোঝার বয়স তো আসবেই একসময়।’ ওদিকে আম্মুও শুরু করল ভাষা শেখানোর তোড়জোড়। প্রতিটি জিনিস দেখিয়ে প্রথমে শেখাত তার বাংলা নাম, তারপর ইংরেজি। দেখা গেল, সেই মেয়েটি ক্লাস ফাইভে উঠতে না উঠতেই দুই ভাষাতেই অনেক বই পড়ে ফেলেছে।
বাড়িতে যখন প্রথম কম্পিউটার এল, পাপা তখন মহা উৎসাহে শিখতে বলল ‘টাইপিং’। মেয়ে যখন মোটামুটি টাইপ করা শিখে ফেলল, তখন নতুন নির্দেশনা—প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখা চাই। বেড়াতে গেছ? কী দেখেছ, কী কী করলে, কার সঙ্গে গেলে, যাত্রাপথে কী কী ঘটনা ঘটল—ঝটপট ইংরেজিতে লিখে ফেলো। ফন্ট: টাইমস নিউ রোমান। ফন্ট সাইজ ১৪।
স্কুলে গিয়ে মেয়ে পড়ল বিপদে। স্কুলে শিক্ষক প্যারাগ্রাফ লেখা শিখিয়ে দেন। তিনি যেমনটা শেখান, হুবহু তেমনই নাকি লিখতে হবে। দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন—কিচ্ছু বাদ দেওয়া যাবে না! তাই মেয়েটা যখন ‘মাই ক্লাসরুম’ প্যারাগ্রাফে লিখল, ‘আমার ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে শিউলি ফুলে ছেয়ে যাওয়া সবুজ মাঠ আর লাল-সাদা দোলনা দেখা যায়,’ তখন শিক্ষক দিলেন কেটে। তবে নিজের লেখার হাত নিয়ে তার আত্মবিশ্বাস কেটে দেওয়া গেল না। কারণ, আম্মু ঠিকই বলল, ‘টিচারের চেয়ে তুমি অনেক ভালো লিখেছ।’
আমিই সেই মেয়ে
যার শুরুটাই এ রকম, তার জন্য বাকি পথটা সহজ হয়ে যায়। আমিই সেই ভাগ্যবতী, যার ভাষার প্রতি ভালোবাসার বীজ বুনে দেওয়া হয়েছে ছোটবেলাতেই, অনেক যত্নে। সবাই নাকি সবকিছুতে ভালো হয় না, আমার ক্ষেত্রেও তাই। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম বরাবরই। প্রকৌশলে ভর্তি হলেও খুব বেশি দূর যেতে পারিনি। ভর্তি হয়ে গেলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে। সেই ছেলেবেলায় সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার যে বীজ বাবা বুনে দিয়েছিলেন, সেটা ডালপালা মেলল নর্থ সাউথে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সহায়তা পেয়ে। কিন্তু আমি তো অকর্মার ঢেঁকি, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রপআউট’। ওদিকে আমার সব বন্ধুবান্ধব ভালো ফল করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে। আমিও সংকল্প নিলাম, ভালো রেজাল্ট ধরে রাখতে হবে, আর বিদেশে গেলে বৃত্তি নিয়েই যেতে হবে।
আইইএলটিএস এবং আমি
উচ্চশিক্ষা প্রস্তুতির প্রথম বৈতরণি হলো আইইএলটিএস, টোয়েফল, জিআরই, জিম্যাটের মতো পরীক্ষাগুলো। ট্রাম্পের দেশে যাব না বলেই জিআরই দিলাম না, তবে এটিও অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। আমি যুক্তরাজ্য এবং কানাডাকে পছন্দের তালিকায় রেখেছিলাম বলে শিক্ষাজীবনের শেষ বর্ষে আইইএলটিএস দেব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেকেই স্নাতকের পাশাপাশি এই পরীক্ষাগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন, কিন্তু আমার হাতে সময় ছিল না। কেননা, আমি ছাত্রাবস্থাতেই দু-দুটো চাকরি করছিলাম। নর্থ সাউথে ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের খাতা দেখে, একটি ইংরেজি পত্রিকার সাহিত্য পাতার খণ্ডকালীন কাজ সেরে, আবার সেমিস্টারের পড়াও পড়তে হচ্ছিল নিয়মিত। সিজিপিএ ৩.৯৮ ধরে রেখেছি বহু কষ্টে। এই কষ্ট জলাঞ্জলি দিতে চাইনি।
আইইএলটিএসের প্রস্তুতির জন্য সব মিলিয়ে আমি মাত্র দুই সপ্তাহ সময় পাই। একটি কোচিং সেন্টারে শুধু মক টেস্ট দেব বলে টাকা দিয়ে এসে বইগুলো নাড়াচাড়া করতে বসলাম। প্রথম মক পরীক্ষা দিয়ে দেখি, লিসেনিংয়ে ৬.৫ পেয়ে বসে আছি। আবিষ্কার করলাম, ব্রিটিশ উচ্চারণের কথা শুনে আমার বিশেষ অভ্যাস নেই (কারণ, আমরা হাজার হোক, নেটফ্লিক্স আমলের মানুষ, মার্কিন উচ্চারণ শুনে অভ্যস্ত)। ইউটিউব ঘেঁটে একের পর এক লিসেনিং টেস্ট দিতে থাকলাম, ফলে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা গেল। মহান আল্লাহ যে সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে আছেন, তার প্রমাণ আমার দুই সপ্তাহের প্রস্তুতিতে পাওয়া আইইএলটিএস স্কোর। লিসেনিং ও স্পিকিং অংশে ৯, রিডিং ও রাইটিংয়ে ৮.৫ পেয়ে আমার ব্যান্ড স্কোর দাঁড়ায় ৯। পরীক্ষার দুই সপ্তাহ পর পাওয়া স্কোরশিট দেখে মুখে কথা সরছিল না। অধিক আনন্দে পাথর হওয়ার এই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।
আমার পরামর্শ
যেকোনো ভাষা শেখার প্রধান শর্ত immersion, বাংলায় বলা যায় আকণ্ঠ অবগাহন। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন বাংলার রাজ্যে ডুবে থাকি, তেমনি ইংরেজির চর্চায় সাধ্যমতো ডুবে যেতে হবে। টেবিল-চেয়ারে বসে পড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলা, কিছু ইংরেজি সিরিজ ও সিনেমা দেখা, দিনে একটি ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ও আপনার দক্ষতা অনুযায়ী প্রচুর বই পড়া এই চর্চার অন্তর্ভুক্ত। তবে হাজার হোক, আইইএলটিএস একটি পরীক্ষা। এখানে পরীক্ষার কিছু কৌশল কাজে লাগালে হাতেনাতে ফল পাওয়া যায় বলেই আমি মনে করি।
লিসেনিং
১. বাক্যগুলোতে কী তথ্য দেওয়া হচ্ছে, লিসেনিং সেকশনে তা কান পেতে শুনতে হবে। বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণ শুনে ভয় না পেয়ে দেখুন, কী বলছে বুঝতে পারছেন কি না। বুঝতে পারাটাই অর্ধেক যুদ্ধজয়।
২. কি-ওয়ার্ড বা মূল শব্দগুলো দাগিয়ে ফেলতে হবে। পরীক্ষার সময় যে রেকর্ডিং বাজানো হয়, সেখানে প্রতিটি অংশের প্রশ্নের ওপর চোখ বুলিয়ে নেওয়ার কিছু সময় দেওয়া হয়। সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে প্রশ্নে কী চাওয়া হচ্ছে, সে–জাতীয় শব্দ পেনসিল দিয়ে দাগিয়ে নেবেন। তারপর যখন রেকর্ডিংয়ে কথোপকথন শুরু হবে, তখন দেখবেন সেই শব্দগুলোর দিকেই মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। তখন চট করে উত্তর লিখে ফেলবেন।
৩. আমার সবচেয়ে অপ্রিয় ছিল ম্যাপের প্রশ্ন, আর সেটির জন্য একটি সহজ টিপ (‘টিপস’ নয়, সেটি বহুবচন)। ম্যাপের ‘স্টার্ট’ লেখা তিরচিহ্নিত অংশটি আপনার দিকে ঘুরিয়ে নেবেন, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-ডান-বাঁ যেন আপনার মোতাবেক হয়।
রিডিং
১. এই অংশে অনেকে প্যাসেজের আগে প্রশ্নগুলো দেখে নিতে পছন্দ করেন। প্রথমে যে প্যাসেজগুলোই পড়তে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি কোন পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তা পরখ করে দেখুন।
২. আবারও বলব, কি-ওয়ার্ড দাগিয়ে নিন। প্রশ্নে দাগিয়ে নিতে পারেন, তখন প্যাসেজে সেই শব্দ বা তার সমার্থক শব্দ পেলেই বুঝবেন এখানে উত্তর লুকিয়ে আছে। আইইএলটিএসের প্যাসেজগুলো আসলে প্যাসেজ নয়, একেকটা এসে (essay)। তাই দ্রুতপঠন ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পড়তে পারা (স্কিম করা) খুব জরুরি।
৩. ম্যাচিং–জাতীয় প্রশ্ন এলে যে অপশনগুলো ব্যবহার করে ফেলেছেন, তার পাশে উত্তরের নম্বর (সাধারণত রোমান নিউমেরাল) লিখে ফেলুন। অপশনগুলো কেটে দেবেন না, বরং নম্বর লিখলে পরে ভুল হয়ে গেলে রাবার দিয়ে মুছে উত্তর বদলে নেওয়ার সুযোগ থাকে।
রাইটিং
১. লেখার হাত সবার ভালো হবে, এমন কোনো কথা নেই, তবে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমার বাবা যেভাবে ছোটবেলায় আমাকে দৈনন্দিন বিষয়ে লেখাতেন, আপনিও তেমনটা করতে পারেন। নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলে গ্রামারের ভুল সংশোধন করে নিলে লেখার মান উন্নত হবেই।
২. আমি বলব, ‘পার্ট টু’ দিয়ে শুরু করুন ও ৩০ মিনিটে ২৫০ শব্দ লিখতে নিজেকে প্রস্তুত করুন। পরীক্ষার হলে যদিও দ্বিতীয় সেকশনের জন্য ৪০ মিনিট পাবেন, তবু সাবধানের মার নেই। ভূমিকার মধ্যে একটি বাক্যে কী কী যুক্তি দিচ্ছেন, তা পরীক্ষককে জানিয়ে দিন। প্রতিটি যুক্তির জন্য একটি প্যারা লিখুন, মোট চারটির বেশি নয়। শেষে উপসংহারে যুক্তিগুলোর কথা আবার নিয়ে আসুন এবং বলুন যে এই যুক্তিগুলোর কারণে আপনি এমনটা মনে করেন।
৩. প্রথম সেকশনে একটি গ্রাফ বা চার্টের ওপর লিখতে হয়। প্রথমেই দেখবেন কোনো বড় ধরনের উন্নতি বা অবনতি গ্রাফ দেখে বুঝতে পারছেন কি না। প্রথম প্যারাগ্রাফে সেটা লিখুন। তারপর বাকি গ্রাফটি ধীরে ধীরে বুঝিয়ে লিখুন।
স্পিকিং
১. স্পিকিংকে যমের মতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এমনটা বলছি না। তবে ভয় পেলে চলবে না। মক টেস্ট দেওয়ার সময় স্পিকিং মক দিতে এবং মক পরীক্ষকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
২. স্পিকিংয়ের মাঝামাঝি পর্যায়ে এক মিনিট প্রস্তুতি নিয়ে দুই মিনিট উপস্থিত বক্তৃতা অংশটির জন্য আয়নার সামনে, বন্ধুদের সঙ্গে ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চর্চা করলে মানুষের সামনে কথা বলার জড়তা কেটে যাবে।
৩. চেষ্টা করবেন কোনো শব্দ ভুলভাল বলে ফেললে একটু কৌতুকের ছলে সামলে নিতে। আমার পরীক্ষার সময় আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম বুঝতে পেরে হেসে বলেছি, ‘I shouldn’t be nervous today of all days right?’ পরীক্ষকও আমার সঙ্গে হেসে ফেলেন। তাতে আমার স্পিকিং খারাপ হয়নি।
দিন শেষে আইইএলটিএস একটি পরীক্ষাই বটে। তবে এটুকু বলব, উচ্চশিক্ষার পথে আপনার পরীক্ষার পালা তো সবে শুরু! কানাডার মেকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ (ইসিএস) বিভাগে পড়তে এসে আমি সেই পরীক্ষার চাপ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। জীবন কখনো থেমে থাকে না, তাই জীবনযুদ্ধও শেষ হওয়ার নয়। সৌজন্যে- প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন