সবাই জানে বিএনপি-কে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সবচেয়ে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সরকারের। সেটি হয়তো সত্যিও। পাশাপাশি যোগ-বিয়োগের হিসেবে বলা যায় বিএনপির নির্বাচনে না আসা জাতীয় পার্টির জন্যও লাভজনক। তারা তো এখন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল! কিন্তু একটু গভীরে খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে যে বিএনপি-কে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার দীর্ঘমেয়াদী সুবিধাভোগী জামায়াতে ইসলামী এবং সে কারণে এটা অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না যে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে তার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে জামায়াত। কেউ যদি সাদা চোখের বিশ্লেষণে যুক্তি খণ্ডাতে চায় যে জামায়াত চায়নি কারণ বিএনপিও চায়নি এবং জামায়াত বিএনপির চাওয়াকে বাস্তবায়ন করতেই বরং ভূমিকা রেখেছে। তাদের বিশ্লেষণে একটু গলদ থেকে যাবে।
অবশ্যই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়নি। কিন্তু এটি বিএনপির আংশিক চাওয়া। তারা এটাও চেয়েছিল যে নির্বাচন যাতে কোনভাবেই না হয় এবং সরকার জোর করে নির্বাচন করলেও যাতে মাস কয়েকের মধ্যে পতন হয়। এই তিনটি সুস্পষ্ট চাওয়া মিলেই হয়তো বিএনপির আকাঙ্ক্ষার প্যাকেজকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে। সে বিবেচনায় বিএনপির নির্বাচন বর্জনের চাওয়া আর জামায়াতের নির্বাচন বর্জনের চাওয়া এ দুটি মিলে অবশ্যই যাবে। কিন্তু জামায়াত কি চেয়েছে সরকার যেন কোনোভাবেই নির্বাচন করতে না পারে? জামায়াত কি চেয়েছে নির্বাচন করলেও সরকার যাতে দ্রুতই পতিত হয়? জামায়াত কি সরকারের সাথে তাদের নেতাদের ফাঁসির রজ্জু নিয়ে দরকষাকষিতে গিয়েছে? জামায়াত কি বিএনপির আকাঙ্ক্ষার পালে বাস্তবতা-বিবর্জিত হাওয়া দিয়ে গেছে?
আমার বিবেচনায় বিএনপি এসব হিসেব কষতেই ভুলটি করেছে। জামায়াতের আকাঙ্ক্ষার প্যাকেজ আর বিএনপির আকাঙ্ক্ষার প্যাকেজ যে অন্তর্নিহিতভাবে ভিন্ন সে হিসেবটি তারা করেনি। বুর্জোয়া রাজনীতি করে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ না নিলে বিএনপি ঢের পিছিয়ে পড়বে। আর বিএনপির শূণ্য স্থান আওয়ামী লীগ, জাসদ বা জাতীয় পার্টি নেওয়ার সুযোগও কম। সে স্থান পূরণের সবচেয়ে বেশি দাবিদার বরং জামায়াত। উপজেলা নির্বাচনে তার একটি আগাম প্রদর্শনীই কেবল হয়ে গেল।
এখন অনুমান করা যাক জামায়াতের হিসেব কী হতে পারে। প্রথমত জামায়াতের হিসেব কষতে পারে – নির্বাচন বর্জন করলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিএনপির মতো একটি বুর্জোয়া দল দীর্ঘমেয়াদে তৃণমূল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হবে (ভোটের মাধ্যমেই এসব বুর্জোয়া দল তৃণমূলের সাথে কার্যকর সংযোগ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে পারে) এবং ফলশ্রুতিতে জামায়াতের মতো ধর্মীয় ও চরমপন্থী আদর্শিক একটি দল সে শূণ্যস্থান পূরণ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত সাংগঠনিকভাবে বিএনপি দুর্বল হলে জামায়াতের সারা দেশ জুড়ে থাকা ক্যাডার-নেটওয়ার্ক দ্রুতই সেটি প্রতিস্থাপন করতে পারবে। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এর সাময়িক সুফল পেলেও দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ জামায়াতেরই। তৃতীয়ত জামায়াতকে শক্তিশালী হতে হলে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে হানা দিয়ে নিজেদের ভোট বাড়ানো তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, তার চেয়ে ঢের সহজ হচ্ছে বিএনপির ভোট ব্যাংককে নিজের করে নেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্র শিবিরের উত্থান এরই সাক্ষ্য দেয়। সেখানে ছাত্র শিবির শক্তিশালী হয়েছে আর ধীরে ধীরে ছাত্রদল (বিএনপির ছাত্র সংগঠন) প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। বিএনপি গত দুই দশকে এর থেকে কিছুই শিক্ষা লাভ করেনি। যেখানে শিবির নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানে ছাত্রদলের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। কারণ খুবই স্বাভাবিক। “আসল” ইসলামের খোঁজ পেলে তথাকথিত ”ইসলামপন্থী” লোকজন কেন নকল “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ইসলাম”-এর পেছনে ছুটবে?! জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা এটি বেশ ভালোভাবে জানে এবং সেভাবে তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস না ধরতে পারলে এ বিশ্লেষণকে গুলিয়ে ফেলার সমুদয় আশংকা রয়েছে। কংগ্রেসের পর এই বাংলার আদি ও সব দিক থেকেই প্রধানতম রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিম লীগ যাদের নেতা-কর্মী সারা বাংলা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। বাংলাদেশে এখনও যারা ক্ষমতার রাজনীতিতে মূল প্রতিদ্বন্ধী তারা সবাই মুসলিম লীগের কোন না কোন অংশের প্রতিনিধিত্বকারী। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত “আওয়ামী মুসলিম লীগ” (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) মূলত মুসলিম লীগের অগ্রসর, প্রগতিশীল অংশের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল। মুসলিম লীগের আধুনিকমনা অংশটি বেরিয়ে গিয়ে নতুন এই দলটি করেছে। তারা ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ন্যাপ-এর মাওলানা ভাসানী (যিনি নিজেও মুসলিম থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ করেছিলেন, পরে সেখান থেকে ন্যাপ করলেন) নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ধরে নেওয়া হচ্ছে তাদের ভোটও আওয়ামী লীগের বাক্সেই পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাকী ২২ শতাংশ লোক তো আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। তারা কি ৬ দফার পক্ষে ছিলেন? তারা কারা? অনুমান হচ্ছে তাদের সিংহভাগ মুসলিম লীগের “রক্ষণশীল” অংশ যারা মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে আসাদের দলে ছিলেন না। যার ফলে এরা দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর নীতির প্রতি সর্বদাই সন্দিঘ্নু ছিলেন। পুনরাবৃত্তি করছি তারা মুসলিম লীগের “রক্ষণশীল” অংশ। তো কোন বিবেচনায় রক্ষণশীল? উত্তর হতে পারে দলটি যেহেতু “মুসলিম” লীগ, এবং তারা যেহেতু প্রগতিশীল অংশটিতে যাননি, স্বভাবতই দলের এ অংশটি একটু বেশি রক্ষণশীল, ধর্মীয় অনুশাসনে কঠোর অথবা দলছুটদের চেয়ে ধর্মের প্রতি বেশি অনুরক্ত। তারা প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছেন। ১৯৭০ সনের সেই ২২ শতাংশ লোক তো রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়নি বা মুক্তিযুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগও হয়ে যায়নি। বাস্তবিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের পর সেই ২২ শতাংশ লোক মূলত ক্ষমতাহীন ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের অনেকের ভিন্ন ভূমিকার কারণে এ গ্রুপটির বড় অংশেরই স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করারও অধিকার ছিল না।
তাদের একটা ব্রেকথ্রু দরকার ছিল আর সেটি এনে দিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে রাজনীতি এলোমেলো হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ পায়। মুসলিম লীগের সুপ্ত রক্ষণশীল অংশটিও আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। জেনারেল জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছেন। রাজনীতি করতেন না। তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডও ছিল না। তিনি দল করবেন কিভাবে? কাদের নিয়ে? ক্ষমতায় বসে রাজনীতি করলে যদিও উচ্ছিষ্টভোগীর অভাব হয় না, কিন্তু কেবল তাদের দিয়ে দল হবে? জেনারেল জিয়া অথবা তার রাজনৈতিক উপদেষ্টারা এদিক থেকে বেশ স্মার্ট ছিলেন বলতেই হয়। কারণ কেবল উচ্ছিষ্টভোগীদের নিয়ে রাজনীতি করলে একজন জেনারেলের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এখনও, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ক্ষমতার মূল প্রতিদ্বন্ধী বা প্রাসঙ্গিক থাকতো না। জিয়া নিজে অথবা তার উপদেষ্টাদের পরামর্শেই হোক – ভয়-লোভ-জয় সমুদয় কৌশল অবলম্বন করে তার নতুন দল সৃষ্টি করলেন। একদল লোককে জেলের ভয় দেখিয়ে তার দল করতে বাধ্য করলেন (বিএনপির আজকের নেতাদের সেসব দিনের কথা কি মনে পড়বে? তাদের দল কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? কাদেরকে জোর করে অন্য দল থেকে ভাগিয়ে আনা হয়েছিল? কাদেরকে কথা না শোনায় জেলে পোরা হয়েছিল? আফসোস, তারা এখন কেবল বিএনএফ-এর আবুল কালাম আজাদকেই বিশ্বাসঘাতক ভাবে, তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অথচ তাদের নিজের ইতিহাস-ই কি বিশ্বাসঘাতকতার নয়? হায় ইতিহাস! সে ঘুরেফিরেই আসে!)। আরেকদল লোককে লোভ দেখিয়ে দলে ভেড়ালেন। ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ছিটিয়ে প্রচুর রিক্রুট পাওয়া যায়। তবে জিয়া সবচেয়ে অসাধারণ (আমি অসাধারণই বলবো) যে কাজটি করলেন তা হলো মুসলিম লীগের সুপ্ত রক্ষণশীল অংশটিকে আস্থায় নিতে পারা, নিজের দিকে সফলভাবে টেনে আনা। মুসলিম লীগের রক্ষণশীল অংশটি প্রচণ্ড আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল, ক্ষমতার লড়াই থেকে বহুদিন দূরে ছিল, রাজনীতিতে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়েও তারা সন্দিহান ছিল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে সকল দণ্ডমূণ্ডের কর্তা বনে যাওয়ায় তাদের আক্রোশ ছাইচাপা আগুনের মতো ছিল। একজন জেনারেলের লোভনীয় আহ্বান তাই কোনোভাবেই এড়ানো যায়নি। একই সাথে ক্ষমতা ও রাজনীতিতে পুনর্বাসন! আবার আওয়ামী লীগের উপর প্রতিশোধ। এক ঢিলে তিন পাখি!
কিন্তু একজন জেনারেল যার আবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ও আছে তিনি কিভাবে, কোন কৌশলে মুক্তিযুদ্ধকে “ভারতের আধিপত্য” হিসেবে দেখা একটি গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করলেন? এটি নিয়ে নানা মত, মিথ, বিতর্ক হাজির রয়েছে। কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জেনারেলের ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকেই বিশ্বাসঘাতকদের একজন বলেন, আবার কেউ তাকে সরাসরি পাকিস্তানীদের চরও বানিয়ে দেন। আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে জিয়া কিংবা তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা(দের) রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা ও বুদ্ধিমত্তা। হয়তো এই বুদ্ধিমত্তাই ক্যান্টনমেন্টের ছায়ায় তৈরি একটি দলকে এখনও সঞ্জীবিত রেখেছে। জিয়াউর রহমান – মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের-প্রতি-সন্দিহান মুসলিম লীগের রক্ষণশীল সেই অংশটির মধ্যে প্রথমেই আস্থা-সৃষ্টি করলেন। তাদেরই একজনকে (রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান) তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী করলেন। অন্যদের রাষ্ট্রের, সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন। ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হয়ে গেলে, নিজেরাই রাষ্ট্রের ভাগ্য বিধাতা হয়ে গেলে তখন আস্থার সংকটের প্রাবল্য থাকে না। যদিও বিএনপির দলের উপরিকাঠামোয় জিয়া মডারেটদের, ব্যবসায়ীদের স্থান করে দিয়েছেন, এটা তিনিও জানতেন যে তৃণমূলে তার দলের ভিত্তি কারা। ১৯৭৮ পর্যন্ত আওয়ামী লীগই ছিল মুসলিম লীগের সম্ভবত একমাত্র লিগেসি। ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি-ও হয়ে গেল মুসলিম লীগের আরেক লিগেসি! এটি তাদের মূলধারার রাজনীতিতে টিকে যাওয়ারও মূলমন্ত্র।
বিএনপিকে বা বিএনপির বর্তমান উপদেষ্টাদের সেটিই বুঝতে হবে যে তারা নিজেরা ধর্ম-কর্ম না করলেও, তারা মডারেট হলেও, তাদের ব্যাকবোন, ভিত্তি হচ্ছে মুসলিম লীগের কট্টর, রক্ষণশীল, ধর্মীয় সেই অংশ, এবং তারা সেই অংশেরই লিগেসি বহন করছেন কেবল। তারা নিজেরা কিছুই তৈরি করেননি। যদিও গত দুই দশকে অনেক ভাঙাগড়া হয়েছে। কয়েক প্রজন্মের নতুন ভোটার তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ পারিবারিক কারণে একটি দলের সমর্থক আবার কারো কারো নিজেদের মত তৈরি হয়েছে। কিছু মিথ, কিছু বিশ্বাসও হয়তো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এসব ফলাফল ভোটের বাক্সেও পড়েছে। সব দলের ভোট ব্যাংকই এদিক-ওদিক হয়েছে। এভাবে বিএনপিরও ভোট বেড়েছে, অনেক মুক্তমনা লোকও এখন বিএনপি করে। তবে এটি অনেকটা মানুষের ব্যবসা সম্প্রসারণের মতো। একটি লোক কম্পিউটার ব্যবসা শুরু করলো; সে ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কিং, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বিক্রি প্রভৃতি নানা দিকে তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করলো। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে তার মূল ব্যবসা কম্পিউটার বেচা-কেনা। বিএনপির মূল ব্যবসা, ভিত্তি মুসলিম লীগের রক্ষণশীল ভোটারদের মূল্যবোধ। কারণ এসব মূল্যবোধ প্রজন্ম-থেকে-প্রজন্মে বয়ে বেড়ায়। এক পরিবারের মূল্যবোধ পরিবর্তন হতে কয়েক প্রজন্মও লেগে যেতে পারে। বিএনপি গত তিন দশকে এমন কোন রাজনীতি উপহার দিতে পারেনি যার ফলে দলটির আরেকটি লিগেসি তৈরি হয়েছে যা দলটিকে টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট হতে পারে। সুতরাং দলটির মূল অংশ হিসেবে সেই মুসলিম লীগের রক্ষণশীল মূল্যবোধ এখনো বিদ্যমান। সেটি চলে গেলে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে কোন তফাৎ থাকবে না। ক্ষমতার রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির মতো তারা পার্শ্ব-চরিত্রে পর্যবসিত হবেন, মূল চরিত্র আর পাবেন না।
রক্ষণশীল এই অংশটি সরাসরি ইসলামী দল না করলেও তারা মনে-প্রাণে মোল্লাদের চেয়ে বেশি কট্টর। ধর্মের অবমাননার গুজবে এরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর জ্বালানো, সংখ্যালঘু মেয়েদের ধর্ষণের মাঝে পরকালের নেকি খুঁজে পায়। বিএনপির রাজনৈতিক ব্যাকবোন হচ্ছে এই অংশটি। সুতরাং ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল এই অংশ যদি দেখে জামায়াত ‘ইসলাম’ ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্ধী হয়ে উঠছে, ভোট টানতে চাইছে, এই অংশটি নিশ্চিতভাবেই সেই ‘ইসলাম’ এর প্রতিই হেলে পড়বে। “আসল” ও “ছদ্ম”-ইসলামের দ্বন্দে তথাকথিত আসলেরই জয়ী হওয়ার সুযোগ বেশি। আমার খুব ধারণা, জামায়াত এই হিসেবটিই কষেছে। তারা বিএনপিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিতে চাইছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এর প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। বিএনপির জন্য এখন উভয় সংকট। স্বলমেয়াদ ও দীর্ঘমেয়াদের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাঝে দলটির ভবিষ্যত দাড়িয়ে আছে।
উপসংহার হচ্ছে বিএনপিকে যদি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে জামায়াতের সাথে ঘর করার লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করতে হবে। সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করলে তারা স্বল্পমেয়াদে লাভবান না হলেও (আসন্ন ক্ষমতা না পেলেও) নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে। কিন্তু যদি ত্বড়িৎ ক্ষমতা লাভের আসায় জামায়াতের পরামর্শ অনুযায়ী বা জামায়াতের শক্তি নির্ভর হয়ে চলতে থাকে, তাতে তাদের ক্ষমতা ফিরে না পাওয়ার আশংকা যেমন বেশি, তার চেয়ে ঢের বেশি আশংকা হচ্ছে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার।
বিএনপির ব্যাকবোন ধর্মীয় ভাবে রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে ডানপন্থা জোরালো না হওয়ার কারণ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের নীতি অনুসরণ। তারা দলের বিভিন্ন নেতৃত্ব-পর্যায়ে ব্যবসায়ী, মডারেট, বামপন্থীদের ঠাঁই করে দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশে গত দুই দশক ধরে ক্ষমতার লড়াইয়ে দুটি ‘প্রায়’ মধ্যপন্থার দল কার্যকর ছিল যা উদার গণতান্ত্রিক বিকাশে ‘মোটামুটি’ একটি সহনীয় পরিবেশ বজায় রেখেছিল। যারা এখানে এই দুই দশকে দুই দলের মারামারিতে অসহ্য এবং এটিকে অভাবনীয় মনে করেন, তারা দয়া করে আফ্রিকার রাজনৈতিক সহিংসতার কিছু লেখা, সাহিত্য পড়ে নিবেন। একটি নব্য গণতন্ত্র ও উদীয়মান অর্থনীতিতে সম্পদের বণ্টন, দখল, ভাগাভাগি নিয়ে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার সহিংসতা এড়ানো যাবে না। হানাহানি-মুক্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে নিয়ন্ত্রিত শাসনের দাবী তুলতে হবে – সেটি কথা বলা, সমাবেশ করা, লেখার স্বাধীনতা বিসর্জনের বিনিময়ে হলেও।
যাই হোক, দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি মধ্যপন্থার দলই অস্বাভাবিকরকম ঝুঁকিতে পড়েছে – কেউ নিজের অস্তিত্ব সংকটে আবার কেউ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতার সংকটে। যে বাংলাদেশ এতদিন গর্ব করতো যে এখানে চরমপন্থার স্থান নেই সেই বিশ্বাস, আত্মমর্যাদা কি ঝাঁকি খাবে?! ঝুঁকিগুলো সত্যিই তৈরি হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটি দলেরই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ কি পারবে বিএনপি-কে পুনরায় বিশ্বাস করে (২০০১ সালের মতো) নির্বাচনী রাজনীতিতে ছাড় দিতে? অথবা বিএনপি-কি পারবে ২০০১-০৬ সালে সৃষ্ট মারাত্মক আস্থাহীনতা থেকে আওয়ামী লীগকে বের করে আনতে? কে কতটুকু ছাড় দিতে রাজী হবে, কোন প্রক্রিয়ায় ছাড় দেবে বা পরস্পরের আস্থা অর্জন করবে তার উপরই নির্ভর করছে সংকট উত্তোরণের সম্ভাব্য ফর্মুলা। যদি দুই পক্ষই অনড় থাকে তাহলে জিরো-সাম গেমটি যে কোন পক্ষের জন্যই হন্তারক হতে পারে। খেলায় যে পক্ষটি টিকে থাকবে তারা সাময়িক লাভবান হবে। অপর পক্ষ রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘমেয়াদে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে দুটি দলই হার-জিতের সেই চরম খেলাটিকেই বেছে নিয়েছে। এটি বোধোহয় নিয়তি নির্ধারিতও। কারণ যে পূর্বশর্তগুলো পূরণ হলে আস্থা ফিরে আসতো সেগুলো সময়ের পরিক্রমায় প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে।
চূড়ান্ত বিচারে যেকারণে আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত অধ্যায়ই নির্ণায়ক হয়ে উঠলো। যেকোনো এক পক্ষের চূড়ান্ত পরাজয়ের মধ্য দিয়েই হয়তো এই তিক্ততা থেকে দেশ বেরিয়ে আসবে। এটি যেমন সম্ভাবনা আবার আশংকাও। সম্ভাবনা হচ্ছে তিন দশকের পারিবারিক তিক্ততা, রক্তাক্ত লিগেসির প্রাথমিক পরিসমাপ্তির। আশংকাটি হচ্ছে, আগে যেমনটি বলেছি, চরমপন্থার উত্থান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন