রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, দিলদার কিংবা জাম্বু—নামগুলো শুনলে কিছু দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনার চোখের সামনে ভেসে যায়। ভীষণ কুটকচালে, বাংলার শেষ নবাব, রসিক বন্ধু কিংবা ভয়ানক ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করে তাঁরা দর্শক মাতিয়েছেন বেশ কয়েক দশক। অর্জন করেছেন মানুষের ভালোবাসা, পেয়েছেন পুরস্কার। তবে তাঁদের প্রস্থান হয়েছে নীরবে। প্রিয় এই অভিনয়শিল্পীদের স্বজন, ভক্ত ও সহকর্মীরা কীভাবে স্মরণ করেন?
রওশন জামিল (১৯৩১–২০০২)
দিনগুলো সবার অগোচরেই চলে যায়
সময়টা এমন ছিল, যখন রক্ষণশীল পরিবারের সামনে সংস্কৃতিচর্চার কথা মুখে তোলাই দায়। সেই বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে পায়ে নূপুর বেঁধেছিলেন রওশন জামিল। শুরু করেছিলেন নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ষাটের দশক থেকে নিয়মিত হন চলচ্চিত্রে। বিপুল পরিচিতি পান ১৯৭০ সালে, জহির রায়হানের সিনেমায় অভিনয় করে। তারপর ঋত্বিক কুমার ঘটক, শেখ নিয়ামত আলী, আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতাদের সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বাঙালি পরিবারের ‘কুটিল’ চরিত্রেই অভিনয় করেছেন বেশি। তিন শর মতো সিনেমায় দেখা গেছে তাঁকে। ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য গিয়ে ঠেকেছিল ৩৫ বছরে। এর মধ্যে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, বাচসাসসহ নানা পুরস্কার। রওশন জামিল মারা যান ২০০২ সালের ১৪ মে। এফডিসির প্রশাসনিক ভবনে ঢোকার মুখে তাঁর একটি নামফলক আছে। তাতে খোদাই করে লেখা আছে তাঁর জন্ম–মৃত্যু সাল। তবে ওই দিনগুলোতে তা অগোচরেই থেকে যায়। তাঁর তিন মেয়ে, দুই ছেলে। মেজ ছেলে শহীদ সরোয়ার বলেন, ‘এফডিসি আমার মাকে স্মরণ করলে তো সেটা জানতাম। আমাদের জানামতে কখনো শুনিনি আম্মাকে স্মরণ করা হচ্ছে। তবে আমরা আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করি তাঁর জন্ম–মৃত্যুদিনগুলোতে তাঁকে স্মরণ করতে। আম্মার অসংখ্য ভক্তের কাছে চাওয়া, আপনারা আম্মার জন্য দোয়া করবেন।’
আনোয়ার হোসেন (১৯৩১–২০১৩)
নবাব নেই, আছে তাঁর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
ছাত্র থাকা অবস্থায় মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। সিনেমায় প্রথম খলচরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৫৮ সালে। ৪২ বছরের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন পাঁচ শর বেশি সিনেমায়। স্পর্শ করেছেন জনপ্রিয়তার অনেক মাইলফলক। ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মুকুটহীন নবাব’ হয়ে উঠেছিলেন দর্শকের কাছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। সেবারই শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতার পুরস্কার ওঠে মুকুটহীন নবাবের হাতে। তিনি নেই, তবে সেই পুরস্কার এখনো সাজানো রাজধানীর ক্রিসেন্ট রোডের বাড়িতে। তাঁর হাতে শোভা পেয়েছে একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও আজীবন সম্মাননা। পুরস্কারের স্মারকগুলো আনোয়ার হোসেনের ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় এখনো যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর স্ত্রী নাছিমা আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাঁর একটাই আফসোস ছিল—অভিনয়টা আর করা হলো না।’ আনোয়ার হোসেন অসুস্থ থাকার পরও শিল্পী–নির্মাতা সবার কথা সব সময় মনে করতেন। ২০০১ সালে শরীর খারাপ হতে শুরু করে। তারপর থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে প্রিয় প্রাঙ্গণ থেকে। অসুস্থতা নিয়েই সব শেষ অভিনয় করেন ঘানি সিনেমায়। তারপর বাসার চার দেয়ালের ভেতরই কাটে দিনগুলো। সে সময় খবর নেয়নি কেউ। ২০১৩ সালে চির বিদায় নেন আনোয়ার হোসেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। আনোয়ার হোসেনের মেয়ে জিনাত কামার বলেন, ‘বাবার জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী আমরা নিজেদের মতো করে পালন করি। বাবা বেঁচে থাকতেই তো চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ খবর নেয়নি। মারা যাওয়ার পর খবর নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এতে আমাদের কোনো আফসোস নেই। অনেক প্রচারমাধ্যম বলে, বাবা পরিবারে অবহেলায় মারা গেছেন, তখন কষ্ট হয়। এটা সত্য নয়। পরিবারে তিনি কখনো অবহেলায় ছিলেন না। আমার মা এখন অসুস্থ। কেউ প্রয়োজন বোধ করে খবর নেওয়ার? জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় বাবা যে চলচ্চিত্র অঙ্গনে কাটিয়েছেন, যাঁরা শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তাঁরা যদি বাবার খোঁজখবর নিতেন তাহলে হয়তো তিনি আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতেন, শান্তিতে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেন।’
আনোয়ার হোসেনের ৫ ছেলেমেয়ের ৪ ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। মেয়ে উত্তরায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
জাম্বু (১৯৪৪–২০০৪)
ছেলে সাম্বু এখন যাত্রাশিল্পী
নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্র বললেই সবার আগে থাকত জাম্বুর নাম। পর্দায় তাঁর বেশভূষা, কথাবার্তা, মারপিট ছিল দেখার মতো বিষয়। নামীদামি সব অভিনেতার সঙ্গে সমানতালে অভিনয় করে গেছেন। লেখাপড়া খুব বেশি ছিল না তাঁর। ‘তারা’ নামের একজন প্রয়াত খল অভিনেতা জাম্বুকে এফডিসিতে নিয়ে আসেন। দেখতে গোলগাল ও স্থূলকায় হওয়ায় নির্মাতা দেলোয়ার জাহান তাঁর নাম দেন ‘জাম্বু’। শিষনাগ ছবি দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন এই খল অভিনেতা। বাংলা সিনেমার একসময়ের এই আলোচিত ব্যক্তির অস্তিত্ব এখন এতটাই বিলীন যে তাঁর আসল নাম নিয়ে সিনেমাপাড়ায় রয়েছে নানা মত। অনেকেই জানেন জাম্বুর আসল নাম বাবুল গোমেজ। আবার অনেকে বলেন শুরুতে তাঁর নাম ছিল সুখলাল বাবু। আমরা গিয়েছিলাম এই অভিনেতা একসময় আজিমপুরের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেখানে। সেই বাড়িওয়ালাও জাম্বুকে সম্বোধন করছিলেন ‘সুখলাল বাবু’ নামে। ১৯৪৪ সালে দিনাজপুরে জন্ম জাম্বুর। এরপর থিতু হন মানিকগঞ্জে। কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। একদিন সুযোগ পান খল চরিত্রে অভিনয় করার। আড়াই শর বেশি সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। ২০০৪ সালে মারা যান জাম্বু। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে ডায়মন্ড একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। ছোট ছেলে সাম্বু বেশ কটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাত্রায় অভিনয় করেন। যাত্রার ব্যানারেও লেখা থাকে ‘জাম্বুর ছেলে সাম্বু’। জাম্বুর ভক্তরা সাম্বুকে দেখতে ভিড় করেন। বাবার কারণেই এই পরিচিতি। সাম্বু বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর আর কেউ খবর নেয় নাই। আমি অভিনয় করি বলে ফাইটার ক্লাবের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। এফডিসিতে মাঝেমধ্যে যাই। পরিবারেও বাবাকে সেভাবে স্মরণ করা হয় না। মানুষ দিন দিন ভুলে যাচ্ছে বাবাকে। এটাই কষ্ট দেয়। আর যা–ই হোক, তিনি তো একজন অভিনেতা ছিলেন।’
দিলদার (১৯৪৫–২০০৩)
শুধু পরিবারই মনে রেখেছে তাঁকে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকে ঝাপসা এক ঠিকানা নিয়ে গুলশানের নিকেতনের তিন নম্বর রোডে একটি বাসা খুঁজছি। যেখানে থাকেন দিলদারের বড় মেয়ে মাসুমা। বাসাটি খুঁজতে রতন মিয়া নামে এক গাড়িচালকের কাছে গেলাম। রতন জানালেন, তাঁরা এই ঠিকানায় আর থাকেন না। বর্তমান ঠিকানা পেলাম তাঁর কাছেই। রতন দিলদারের বড় ভক্ত। এ কারণেই তিনি বাড়ি বদল করার সময় ঠিকানাটা রেখে দিয়েছিলেন। রতন বললেন, ‘আমি দিলদারের সব ছবি দেখছি।’ প্রমাণ হিসেবে মোবাইল ফোনে কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখালেন। তাঁর সাহায্যেই খুঁজে বের করি হারিয়ে যাওয়া সেই কিংবদন্তি শিল্পীর মেয়ের ঠিকানা। দিলদারের বড় মেয়ে মাসুমা একজন দন্তচিকিৎসক। বাবা দিলদারের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘কে কী করল না করল এটা আমরা বলতে চাই না। আমরা বাবাকে ঘরোয়াভাবে স্মরণ করি, দোয়া মাহফিলের আয়োজন করি, করব।’ দিলদার হোসেনের স্ত্রী ডেমরায় থাকেন, ছেলের সঙ্গে। পাঁচ শর বেশি সিনেমায় অভিনয় করা দিলদার মারা যান ২০০৩ সালের ১৩ জুলাই। প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান ২০ বছর বয়সে। তাঁর সময়ে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দিলদার—এ মানতেই হবে। মানুষকে হাসিয়েই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর আসনটি এখনো খালিই পড়ে আছে।
এখন দিলদারের জন্ম বা মৃত্যুদিনে কোনো আয়োজনের খবর মেলে না। তাঁর মৃত্যুর পরপর হাতে গোনা কজন স্মরণ–আয়োজন করলেও এখন আর কেউ খবরও নেয় না। এমনটাই জানালেন দিলদারের বড় মেয়ে মাসুমা আক্তার। বললেন, ‘প্রথম দু বছর কেউ কেউ স্মরণ–অনুষ্ঠান করত। এখন আমরাই পারিবারিকভাবে বাবাকে তাঁর জন্ম–মৃত্যু দিনে আয়োজন করে স্মরণ করি। এই যা। বাবাকে যাঁদের বেশি স্মরণ করার কথা, তাঁরাই দিনটি ভুলে থাকেন।’ দিলদারের ছোট মেয়ে জিনিয়া আফরোজ বাবাকে নিয়ে গর্বিত, ‘বাবার ভক্তরা এখনো তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, সম্মান করেন।’
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন