স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে শুরু করেন ব্যবসা। সেই সুবাদে দেশটির শিকাগো শহরে কাটিয়ে দেন দীর্ঘ ২১টি বছর। প্রসার ঘটান গাড়ির পার্টস, রিয়াল এস্টেট ও রেস্তোরাঁ ব্যবসার। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যবসায়িক কারণে নাগরিকত্ব নেন কানাডারও। এককথায় কর্মব্যস্ত বিলাসী জীবন। কিন্তু দেশমাতৃকার টানের কাছে সেসবই তুচ্ছ হয়েছে। ফিরে এসেছেন জন্মভিটায়।
আলোচ্য ব্যক্তিটি আকরাম হোসেন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মরহুম ইসমাঈল বাগমার ছেলে। প্রবাসজীবন ছেড়ে দেশে ফেরা এই যুবক আজ একজন সফল খামারি। একই সঙ্গে জনহিতৈষী উদ্যোক্তাও। নিজের জন্মস্থান শ্রীপুরের প্রহলাদপুর ইউনিয়নের দমদমা গ্রামে গড়ে তুলেছেন বিশাল খামার। ৮০ বিঘা জমিজুড়ে পাঁচটি পুকুরে মাছের চাষ করছেন। পাশাপাশি গরু ও হাঁসের খামারও চালু করেন। এসব খামার থেকে এখন প্রতি মাসে আসছে কয়েক লাখ টাকা।
সফল খামারি আকরাম হোসেন দমদমাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের অর্ধশত যুবককেও প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে খামার করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করেন।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় যুবক শওকত হোসেনের সঙ্গে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি সাড়ে পাঁচ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছের চাষ করছি। আর মাছের পোনা, খাবার, ওষুধ থেকে শুরু করে সব কিছু দিয়ে আকরাম ভাই সহযোগিতা করছেন। তাঁর কাছ থেকে এসব বাকিতে আনি। মাছ চাষ করে তা বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করি। এখনো তিনি তিন লাখ টাকা পাবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিদিন মোবাইল ফোনে তিনি আমার খামারের খোঁজখবর নেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেন। দমদমা গ্রামের পাশের নলগাঁও ইউনিয়নের জয়নাল মিয়া বলেন, ‘জমি বিক্রি কইরা বিদেশ যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু আকরাম ভাইয়ের দিকে তাকাইয়া বিদেশ যাওয়া বাদ দিছি। উনার পরামর্শে মাছ ও মুরগির খামার করছি। মাছের পোনা, মাছ ও খাবারসহ সব কিছুই আকরাম ভাইয়ের কাছ থেকে বাকিতে নেই। মাছ বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করি।’
শুধু শওকত হোসেন আর জয়নাল মিয়া নন, দমদমা, ডুমুরি, বাঁশকোপাসহ আশপাশের সাতটি গ্রামের অর্ধশত পরিবার মাছ, গরু ও মুরগির খামার করে আজ স্বাবলম্বী। আর তাদের খামার গড়ার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে বাকিতে মাছের পোনা, খাবার, ওষুধ সরবরাহ করাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন আকরাম হোসেন। একসময়ের এই প্রবাসীকে মডেল হিসেবে ধরে অনেকেই বিদেশে যাওয়া ছেড়ে খামার ব্যবসায় ঝুঁকছেন এবং পরিবারে সচ্ছলতা আনছেন।
আকরাম হোসেন সম্পর্কে জানতে চাইলে দমদমা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আয়নাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাগো গ্রামের পোলারা দেশ ছেড়ে দুবাই-মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পাগল। সেইখানে আমেরিকার মতো উন্নত দেশ ছাইড়া দেশে চলে আসছে আকরাম। গ্রামে মাছ, গরু আর হাঁসের খামার দিছে। আকরামের খামার দেইখ্যা এলাকার পোলারা মাছের খামার করছে।’
ডুমুরি গ্রামের আসলাম হোসেন বলেন, ‘মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু যাইতে পারি নাই। আকরাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিদেশ যাওয়ার কথা ভুলে দেশে মাছের খামার করছি। তিনি পুঁজি ছাড়া ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। দেশে এমন উদ্যোক্তা দরদি মানুষের সংখ্যা বাড়লে গ্রামে আর বেকার থাকব না। মানুষের দুঃখও দূর হয়ে যাবে।’
উদ্যোক্তা ও সফল খামারি আকরাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এইচএসসি পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ না করে ব্যবসায় মনোযোগী হই। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। গাড়ির পার্টস, রিয়াল এস্টেট ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ভালোই চলছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কানাডায়ও ব্যবসা করি এবং সে দেশের নাগরিকত্ব পাই। ২১ বছর ধরে সেখানে ভালোই কাটছিল। কিন্তু ভাবলাম, নিজের দেশের জন্য, নিজ গ্রামের জন্য কিছু একটা করা যায় কি না। সেই ভাবনা থেকেই তিন বছর আগে দেশে চলে আসি। পরের দেশের জন্য ২২ বছর শ্রম দিয়ে এলাম। এবার নিজের দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। আর সেই তাগিদ থেকেই গ্রামে এসে মাছের খামার করছি।’
নিজের পুকুরের মাছ থেকে পোনা উৎপাদন করেন আকরাম। মাছের খাবার তৈরির মেশিনটি নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর কারখানায় তৈরি করা খাবার এবং হ্যাচারির পোনা উপজেলার বিভিন্ন মাছের খামারে যাচ্ছে। আকরাম বলেন, ‘কেউ মাছের খামার করতে চাইলে তাদের বাকিতে পোনা ও মাছের খাবার সরবরাহ করি। পুকুর কাটতে টাকা লাগলেও বিনা সুদে ঋণ দেই। এ পর্যন্ত যারা আমার কাছ থেকে পোনা, খাবার ও ঋণ নিয়েছে সবাই টাকা পরিশোধ করেছে আবাদ করা মাছ বিক্রির পর। আমার দ্বারা যদি গ্রামের দুজন মানুষের পরিবারে কষ্ট দূর হয় তাতেই আমার আনন্দ।’
আকরাম বলেন, ‘মাছ চাষ শুরু করেছিলাম ১২ বিঘা আয়তনের পুকুরে। এখন প্রায় ৮০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করছি। চলতি বছরই আরো ৬০ বিঘা আয়তনের তিনটি পুকুরে মাছ চাষ করব। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই খামারেই অবস্থান করি। মাছের খামারের পাশেই রয়েছে গরুর খামার। খামারে ৪০টি গরু মোটাতাজা করার কাজ চলছে, রয়েছে হাঁসের খামারও।’
খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে স্ত্রী মনিরা সুলতানা মুনমুন নানাভাবে উৎসাহ দেন জানিয়ে আকরাম বলেন, ‘নিজ গ্রামে খামার করব জানাতেই আমার স্ত্রী বাধা দেয়নি। সে নানাভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। আমার ছোট্ট মেয়ে মিফতা হোসেনও প্রায় সময় খামারে এসে সময় কাটায়।’
খামার দেখভালের জন্য আকরাম হোসেনের ১২ জন কর্মচারী রয়েছে। প্রতিজনকেই পরিবার নিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের সন্তানের লেখাপড়ার সব খরচও দেন তিনি। খামারের কর্মচারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওরা আমার সহযোগী। ওরা কষ্টে থাকলে আমি কখনো ব্যবসায় লাভবান হতে পারব না।’
কর্মচারীরাও যথেষ্ট খুশি। কর্মচারী পরিমল চন্দ্র দে বলেন, ‘এটা বাবুর (আকরাম) খামার নয়, এটা আমাদের খামার। সেভাবেই আমরা কাজ করি।’
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন