গান আর অভিনয়ের কারণে ছোটবেলা থেকে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন সেলেনা গোমেজ। মাত্র ২৭ বছর বয়সী এই মার্কিন শিল্পী একাধিকবার জিতেছেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকী আর প্রতিষ্ঠানের জরিপে প্রভাবশালী অনূর্ধ্ব-৩০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর নাম। সম্প্রতি এই গায়িকা ও গীতিকার নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে নেটফ্লিক্সের লিভিং আনডকুমেন্টেড তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ উপলক্ষে ১ অক্টোবর টাইম সাময়িকীতে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেটির সংক্ষিপ্ত রূপ আজ থাকছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাঠকের জন্য।
১৯৭০-এর কথা। আমার ফুফু মেক্সিকোর সীমান্ত পার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্য একটা ট্রাকের পেছনে উঠে গেলেন। তাঁর পিছু পিছু একই পথ ধরলেন আমার দাদা-দাদি। এর পরপরই আমার বাবার জন্ম হলো টেক্সাসের মাটিতে। ১৯৯২ সালে আমার জন্ম হয় একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে। এ জন্য ধন্যবাদ আমার ফুফু আর দাদা-দাদিকে, সেই দিনের সেই সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের জন্য। চার দশক ধরে আমার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ নাগরিকত্বের জন্য রাত–দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অবৈধ অভিবাসন এখন এমন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাকে প্রতিদিন ভাবায়। প্রতিদিনই নিজেকে অসম্ভব সৌভাগ্যবান মনে হয় এই ভেবে যে, আমি এই দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) মাটিতে জন্মাতে পেরেছি। আমার পরিবার আর আমার পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে এ জন্য প্রতিদিনই কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমি। কিন্তু যখনই আমি খবরের শিরোনামে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো বিতর্কে অভিবাসন পরিস্থিতি নিয়ে ভয়ংকর গল্পগুলো শুনি, আমার অভিবাসন সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য ভয় লাগে। আমার দেশের জন্য আমার ভয় হয়।
অভিবাসন হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে একটি দ্বিধাবিভক্ত ইস্যু। এটা হচ্ছে অনন্তকাল চলতে থাকার মতো বিতর্ক এবং অগণিত গল্পে ভরা একটি বিষয়। কিন্তু অভিবাসন পরিস্থিতি আসলে রাজনীতি ও খবরের শিরোনামের ঊর্ধ্বে। এটা আদতে একটি মানবিক সমস্যা, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে, জীবনকে তছনছ করে দেয়। এই পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, এর ওপর নির্ভর করে আমাদের মানবিকতা, উদারতার মাত্রা। আমরা কীভাবে তাঁদের পাশে থাকব, সেটার ওপর নির্ভর করে আমরা আসলে কতটা মানুষ বা মানবিক।
আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই। আমি রাজনীতিবিদ নই, চিকিৎসকও নই, এমনকি আমি এসব প্রশাসনিক বিভাগের অংশও নই। তবে আমি বুঝি, চলমান প্রক্রিয়ায় কিছু গলদ আছে এবং এর জন্য আমাদের নতুন নিয়ম ও নীতিমালা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যে দেশে বাস করছি, নানা দেশের মানুষ মিলেই এর জন্মই হয়েছিল। এখন তাঁদের কথা মন দিয়ে শোনার সময় এসেছে, যাঁদের জীবন বর্তমান অভিবাসন নীতিমালার কারণে সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে; যাদের জীবনের জটিল গল্পগুলো সামগ্রিকভাবে অভিবাসন সংকট নামে উঠে আসছে খবরের শিরোনামে।
২০১৭ সালে আমার কাছে ‘লিভিং আনডকুমেন্টেড’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব আসে। এই তথ্যচিত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ৮টি অভিবাসী পরিবারের গল্প তুলে ধরা হয়। প্রতিটি পরিবার বিতাড়নের মধ্য দিয়ে গেছে, যাচ্ছে। তাঁদের এই সংগ্রামের ভিডিও চিত্র দেখে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। লজ্জায় কুঁকড়ে গেছি। মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার পরিবারের সংগ্রামটাই দেখছি। তবে এই ভিডিও চিত্রের কিছু অংশে আমি আশা দেখেছি, দেখেছি অনেক কষ্ট সহ্য করেও নতুন একটা দেশকে আপন করে নেওয়ার পরের দেশপ্রেম।
গত মাসে ‘লিভিং আনডকুমেন্টেড’ তথ্যচিত্রে থাকা তিন তরুণ অভিবাসীর সঙ্গে আমি দেখা করি। এদের মধ্যে ছিল বার নামে এক স্বপ্নচারী। বারের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তাকে নিয়ে তার পরিবার যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে ইসরায়েল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। আর বাকি দুজন হলেন সহোদর পাবলো ও কামিলো দুনোয়ের। এই দুই ভাইয়ের পরিবার ২০০২ সালে কলোম্বিয়া থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে।
বার আমাকে বলল, তার ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছা আছে। জীবনের শুরু থেকে খুব ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হয়েছে তাকে ও তার পরিবারকে। এক সপ্তাহে আগে সে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে। কিন্তু ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারছে না। কারণ পুলিশ তদন্ত শুরু করলে জেনে যেতে পারে, তার মা-বাবা যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ অভিবাসী।
কয়েক মাস আগে সান দিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য পাবলোর করা আবেদন গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখন আর পাবলো সেখানে পড়তে পারবে না। কারণ আগস্ট মাসের এক দিন পাবলোর বাবা রবের্তো দুনোয়ের কাজের জন্য বেরিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। স্থানীয় অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন কর্তৃপক্ষ আটক করে রবের্তোকে। তাঁকে আরও কয়েকজন অভিবাসীর সঙ্গে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। সেই কারাগারে শীত থেকে বাঁচার জন্য একটা পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের কাগজ দেওয়া হতো আর মাথার ওপর সব সময় জ্বলত কড়া একটা বাতি। পাবলো বলল, এমন যন্ত্রণা আর কষ্ট পাবলো তার বাবার কণ্ঠে কোনো দিন শোনেনি। এই যন্ত্রণা আজীবন পাবলোকে তাড়া করে বেড়াবে—সেই ভয় দেখা গেল তরুণ অভিবাসীর চোখে। আট দিন কারাগারে মানবেতর জীবনযাপনের পর পাবলোর বাবা রবের্তোকে কলোম্বিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে পাবলো ও তার ভাই কামিলো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বাড়ি ফিরতে পারছে না, রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারছে না। হাতে থাকা সময় ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় তাদের প্রতিমুহূর্তে কুরে কুরে খাচ্ছে। কামিলো আমাকে বলল, বিতাড়নে ভয় নেই তার। ভয় হলো হারিয়ে যাওয়ার, গুম হওয়ার, খবরের কাগজে শুধু পরিসংখ্যান হয়ে থেকে যাওয়ার।
আমার দেশে মানুষেরা যেভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত। আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমি এখন সেসব মানুষের কথা বলতে চাই, যারা মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না; একজন মেক্সিকান-মার্কিন হওয়ার সুবাদে আমি এটাকে নিজের দায়িত্ব মনে করছি। আমি আশা করব, বিতাড়নের শিকার হওয়া অভিবাসী পরিবারগুলোর গল্প আমাদের সবাইকে ভাবাবে, আরও মানবিক করে তুলবে। এই গল্পগুলো অভিবাসী আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে আমাদের পড়াশোনা করার আগ্রহ বাড়াবে এবং নিজের মত প্রকাশে সাহসী করে তুলবে। আমি আশা করি, বার একদিন ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে এই দেশে পড়ার সুযোগ পাবে। পাবলো ও কামিলো আবার নিজের ঘরে গিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।
যখন আমি ‘লিভিং আনডকুমেন্টেড’ তথ্যচিত্রে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হই, তখনই আমি এ বিষয়ে যাবতীয় সমালোচনা মোকাবিলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে আমি যে সমালোচনার শিকার হব, এই যন্ত্রণা অভিবাসী পরিবারের কষ্টের সামনে কিচ্ছু না। ভয় আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা সব ভয়কে পেছনে ফেলে এই বিষয়ে জানব, পড়ব। আমরা জানব, কীভাবে লাখো পরিবারের জীবন এই জোর করে বিতাড়নের মধ্য দিয়ে ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। ভয় আমার ফুফুকে ট্রাকের পেছনে চড়ে বসা থেকে থামাতে পারেনি। এ জন্যই আজ আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছি। এ জন্যই আজ আমি স্বাধীনভাবে আপনাদের সামনে নিজের কথা বলতে পারছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন