'অনেক কথা যাও গো বলে কোনো কথা না বলে'- রবীন্দ্রনাথের এই অমর পঙ্ক্তি শোনা হয়নি এমন সভ্য বাঙালি বোধকরি কমই আছেন। কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশীরা কী জানেন, সাক্ষাৎকারে এই না বলা কথা, অর্থাৎ শারীরিক ভাষাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা এও দাবি করেন, সাক্ষাৎকারের প্রথম আড়াই মিনিটেই একজন অভিজ্ঞ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী তার প্রার্থী সম্পর্কে যে প্রাথমিক ধারণা পোষণ করেন, তা-ই অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন পরীক্ষার্থীর চাকরিপ্রাপ্তির ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। যেটা একজন পরীক্ষার্থী হয়তো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই তার পরীক্ষক অবলোকন করে থাকেন। এটাই হলো শারীরিক ভাষা। এ ক্ষেত্রে একটা প্রবাদসম কথা প্রচলিত আছে আর সেটি হচ্ছে- It’s not what you say, it’s what you do। আর সে জন্যই আধুনিক মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন এবং করে চলেছেন। তাদের মতে, সাক্ষাৎকারে একজন প্রার্থীর সাফল্যের ৫৫ ভাগ শারীরিক ভাষা, ৩৮ ভাগ গলার স্বর ও বলার ধরন, অর্থাৎ উপস্থাপন এবং মাত্র ৭ ভাগ জ্ঞান ও মৌখিক প্রকাশের ওপর নির্ভর করে।
আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী : বাংলা সংস্কৃতিতে বহুল প্রচলিত এই বাগধারা যে কোনো সাক্ষাৎকার প্রার্থীর জন্যই স্মরণীয়। ইংরেজিতে বলা হয়- Frist impression is the best impression। গবেষকদের মতে, যেসব প্রার্থী শারীরিকভাবে মার্জিত ও সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী, তাদের প্রতি নির্বাচকদের একটি আলাদা বিবেচনা কাজ করে। তাদের মতে, সাধারণত সাক্ষাৎকারের প্রথম দেড় মিনিটের মধ্যে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা তাদের ৯০ শতাংশ মতামত গঠন করেন। একজন প্রার্থী এই প্রাথমিক পজিটিভ প্রভাব তৈরি করতে পারেন খুব সাধারণ কিছু বিষয় অনুসরণ করেই। প্রথমত, অনুমতি সাপেক্ষে দরজা দিয়ে ঢোকা, মৃদু হাসি ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বা গ্রহণকারীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় এবং অনুমতি সাপেক্ষে নির্ধারিত স্থানে বসা। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর পোশাক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সময় ও সংস্থা বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন- অতিসংবেদনশীল রং ও আঁটসাঁট কাপড় ব্যবহার না করা (হালকা রঙের কাপড়ই শ্রেয়), পরিস্কার জুতা, মার্জিত ঘড়ি ও বেল্ট (পুরুষদের ক্ষেত্রে) পরিধান করা, মার্জিত চুলের ছাঁট (দাড়ি রাখতে অভ্যস্ত হলে তা রুচিকরভাবে ছেঁটে রাখা), মেয়েদের ক্ষেত্রে শালীন পোশাক তথা হালকা রঙের সালোয়ার-কামিজ/শাড়ি পরাই শ্রেয়।
আত্মবিশ্বাসী হোন : জীবনের সর্বক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী মানুষ অন্যদের চেয়েও একটু আলাদা। তাদের সফলতার হারও তাই বেশি। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সামরিক দার্শনিক Sun Tsu বলেন, 'Winners won the war before it breaks out and looser lost it before they go for the war.' সাধারণত চাকরির সাক্ষাৎকারে কোনো সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি থাকে না। একমাত্র নিশ্ছিদ্র এবং নিরলস পূর্বপ্রস্তুতিই সাক্ষাৎকারের মূলমন্ত্র। এই পূর্বপ্রস্তুতি শুরু হতে পারে নিজ সম্পর্কে জানা, যে সংস্থার চাকরিপ্রার্থী, সেই সংস্থা ও পদ (অর্থাৎ দায়িত্বাবলি) সম্পর্কে ধারণা অর্জন এবং আপনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তা ঝালাই করে নেওয়া। এসব প্রস্তুতি আপনাকে করবে আত্মবিশ্বাসী, যা পজিটিভ শারীরিক ভাষার মূল চাবিকাঠি।
ভয় ও স্নায়ুচাপ জয় করতে শিখুন : 'স্ট্রেস বা নার্ভাসনেস' সাক্ষাৎকারের সময় প্রার্থীর স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সাক্ষাৎকারকালে প্রার্থীর একটি নির্দিষ্ট মাত্রার স্ট্রেস থাকবে- এটা স্বাভাবিক। এটি প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয় না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সব সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আশা করেন, প্রার্থী কিছুটা নার্ভাস থাকবেন। তবে তা কখনোই সীমা অতিক্রম করে নয়। যখন এই সীমা অতিক্রম করে, তখন প্রার্থীর হৃদকম্পনের মাত্রা বেড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গলা শুকিয়ে আসে, ঘন ঘন ঢোক গিলে, মুখমণ্ডল ও কাঁধের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং তিনি কাঁপতে থাকেন। গবেষকদের মতে, সাধারণত ভয় থেকেই মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। একজন চাকরিপ্রার্থীর ক্ষেত্রে এই ভয় হচ্ছে 'অজানার ভয়'। তাই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আপনার মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এ ক্ষেত্রে শ্বাস ধরে না রেখে বরং দীর্ঘশ্বাস নিতে হবে। গভীরভাবে শ্বাস নিলে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সঞ্চালন হয়, যা সাক্ষাৎকারকালীন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। শান্ত, ধীর ও স্থির থাকুন। এ জন্য সাক্ষাৎকারের যথেষ্ট আগে নির্ধারিত অফিস বা সংস্থায় পৌঁছান। অভ্যর্থনাকারীর সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময়ের পর তার দেখানো অপেক্ষাগারে বসুন। এ সময়ে ছটফট না করে চেষ্টা করুন কোনো সংবাদপত্র কিংবা ম্যাগাজিনে মনোনিবেশ করতে। এভাবে আপনি নিজেকে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে সক্ষম হবেন। আর যখন আপনার সাক্ষাৎকারের সময় আসবে, তখন ধীরস্থিরভাবে চেয়ার থেকে উঠে সাক্ষাৎকার রুমে প্রবেশ করুন।
হতবিহ্বল হবেন না : কখনও কখনও খুব ভালো এবং বিনয়ী আচরণের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীও এমন প্রশ্ন করেন যে প্রার্থী ঘাবড়ে যান। প্রায়ই এটি করা হয়ে থাকে সুপরিকল্পিতভাবে। প্রশ্নকর্তা দেখতে চান, চাপের মুখে আপনি কেমন আচরণ করেন/আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। এ জাতীয় প্রশ্ন সাধারণত শুরু হয় এভাবে যে, আপনি যদি অমুক হতেন অথবা অমুক পরিস্থিতিতে আপনি কী করবেন/করতেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শান্ত থাকা, চিন্তা করার জন্য সময় নেওয়া, এমনকি প্রশ্ন না বুঝলে স্পষ্টকরণ করা। না বুঝে উত্তর দিলে তা ভালোর চেয়ে খারাপ ফলই এনে দেয় বেশি। তাড়াহুড়া না করে প্রশ্ন বুঝে উত্তর দিতে হবে।
মুদ্রাদোষ পরিহার করুন : সাক্ষাৎকারকালে আকাঙ্ক্ষিত শারীরিক ভাষা যেভাবে একজন প্রার্থীর যোগ্যতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়, একইভাবে অযাচিত শারীরিক ভাষা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। এর সব নির্মূল করা সম্ভব না হলেও অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কারণ, কিছু কিছু শারীরিক ভাষা আমরা নিজের অজান্তেই করে ফেলি, আর কিছু আছে যা দীর্ঘদিনের বদভ্যাসে কিংবা পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পা নাচানো/দোলানো, কথা বলার সময় ঠোঁটের কোণে থুতু জমা হওয়া, দুই হাত কচলানো, আঙুল বা তর্জনী ঘোরানো, মাথা চুলকানো, ভ্রু নাচানো, কাঁধ ঝাঁকানো, জুতার অগ্রভাব দিয়ে মেঝে ঠোকা কিংবা ঠোঁট কামড়ানো। এসবই আপনার অজান্তে আপনাকে অযোগ্য করে তুলতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা আবশ্যক। সে জন্য প্রথমেই আপনাকে আপনার অযাচিত মুদ্রাদোষ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। যা আপনি আপনার কাছের মানুষের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। তা ছাড়া আয়নার সামনে অথবা ভিডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর পুনঃপুন সতর্ক অনুশীলনের মাধ্যমে অধিকাংশ মুদ্রাদোষ দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারকালে আপনার যেসব মুদ্রাদোষ হয় কিংবা হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকা সম্ভব।
বলার ধরন ও ভঙ্গি সাবলীল রাখুন : কথায় আছে- A picture is worth a speaks thousand words । তেমনি সাক্ষাৎকারকালে একজন প্রার্থীর বলার ধরন ও ভঙ্গি উচ্চারিত শব্দের চেয়ে বেশি কথা বলে। অনেকে মনে করেন, প্রার্থীর সংশ্নিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান থাকলেই হলো। আদতে তা নয়। প্রার্থী যা বলছেন, তা তিনি বুঝে বলছেন কিনা কিংবা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন- তা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কাছে ঢের গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ কথা বলার সময় 'উম', 'এ্যাঁ', 'ইম', 'লাইক' কিংবা 'হচ্ছে গিয়ে' ইত্যাদি নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন, যা অনুচিত। এ ছাড়া কারও কারও কথায় আঞ্চলিকতার টান অতিমাত্রায় প্রকাশ পায়, যা আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারের শ্রুতিমাধুর্যকে বিনষ্ট করে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর একই স্বর ও মাত্রায় না দেওয়াই শ্রেয়। অর্থাৎ প্রশ্নের ধরন ও ব্যাপকতা বুঝে এবং সঙ্গে প্রশ্নকর্তার সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুধাবন করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। যেমন জটিল কিংবা অতিসংবেদনশীল কোনো প্রশ্নের উত্তরের আগে কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দেওয়ার অর্থ আপনি যা বলছেন, তা ভেবেচিন্তেই বলেছেন। অন্যদিকে একটি সাধারণ প্রশ্নের ঝটপট উত্তর আপনার প্রত্যুৎপন্নমতিতারই পরিচয় বহন করবে।
শেষ পর্যন্ত মনোবল ধরে রাখুন : সাক্ষাৎকারকালে প্রশ্ন কিংবা প্রশ্নকর্তা যতই কঠিন হোক না কেন, হাল ছাড়বেন না। বিশেষত আপনার শারীরিক ভাষায় তা যেন প্রকাশ না পায়। যেমন- মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করা, নির্লিপ্ত চোখ, প্রাণহীন মুখের অভিব্যক্তি কিংবা অসার দেহভঙ্গি। তা ছাড়া উত্তর দেওয়ার সময় কাঁধের ঝাঁকুনির মাধ্যমে উত্তর দেওয়া প্রশ্নকর্তা এবং তার প্রশ্নকে অবজ্ঞার শামিল। তাই অনিচ্ছাকৃত হলেও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আবার কখনও কখনও গলার স্বরের অস্বাভাবিক অবনমনও আপনার হাল ছেড়ে দেওয়ার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। মনে রাখবেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো একটি সাক্ষাৎকারেও আপনি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন কিংবা এক বা একাধিক প্রশ্নের উত্তর আপনার নাও জানা থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে, আপনার আর কোনো আশা-ভরসা নেই। এ ক্ষেত্রে নচিকেতার গানের কলি মনে রাখবেন- হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।
উপসংহার : বিশ্বখ্যাত শারীরিক ভাষা ও সম্পর্ক-বিশারদ Allan Pease তার আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধ বই 'Body Language'-এ উল্লেখ করেছেন, শারীরিক ভাষা একটি জটিল প্রক্রিয়া; যেখানে ব্যক্তির উচ্চারিত শব্দ, ধরন, ভঙ্গি এবং সর্বোপরি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া সম্পৃক্ত। এই অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়াকে এ লেখায় সহজ ও বোধগম্য করে উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকার প্রার্থীরা এ থেকে কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন বলে অনুমেয়। কারণ মনে রাখবেন, যারা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, তারা সাক্ষাৎকার প্রার্থীর শারীরিক ভাষা পর্যবেক্ষণে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমলে নিয়ে স্ব-স্ব ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক : ডেপুটি প্রেসিডেন্ট, আন্তঃবাহিনী নির্বাচন পর্ষদ, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, ঢাকা সেনানিবাস
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন