জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়; একটি চেতনার নাম, একটি আদর্শের নাম, একটি দর্শনের নাম, বঙ্গবন্ধু মানে একটি ইতিহাস; যে ইতিহাস জন্ম দিয়েছে একটি দেশের; দেশটির নাম বাংলাদেশ। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে অনেক সিনিয়র নেতাকেও তিনি চমকে দিয়েছিলেন। ২৬ বছর বয়সে ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিএস নির্বাচিত হন। বয়স যখন ২৭ বছর তখন বিশ্বের একজন অবিসংবাদিত নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (তখন বয়স প্রায় ৮০ বছর, জন্ম ২ অক্টোবর ১৮৬৯) সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। একই বছরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাত্র ২৯ বছর বয়সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি হিসেবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (তখন বয়স ৬৯ বছর, জন্ম ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০) ও সাধারণ সম্পাদক শামছুল হকের (তখন বয়স ৩১ বছর, জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮) মতো জাঁদরেল নেতাদের নামের পাশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তৃতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রাপ্তি কেবল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ নেতৃত্বের গুণেই সম্ভব হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুই সদ্য গড়া আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সূচনালগ্ন থেকেই জোরালোভাবে সোচ্চার করেছিলেন। নবীন দলটিকে খুব দ্রুতই যেন একবারে কিশোর থেকে অগ্নিঝরা উত্তাল যৌবনে নিয়ে গেলেন।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন মাত্র ৩৩ বছর, সেই থেকে একাধিক্রমে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি (আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৪৩টি) আসনে জয়ী হয়, বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হলেন। ওই বছরই ১৯৫৪ সালের ১৫ মে বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের (তখন বয়স ৮১ বছর, জন্ম ২৬ অক্টোবর ১৮৭৩) নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বঙ্গবন্ধু ঠান্ডা মাথায় এদেশের মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে ৪৬ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা পেশ করলেন এবং ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বিশাল ছাত্র সমাবেশ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হলেন। ৪৯ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন অবিসংবাদিত নেতা।
এদিকে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন শাসনে শুধু যে অতিষ্ঠ ছিল তাই নয়; তাদের কবজা থেকে রেহাই পেতে সবাই মরিয়া। ছয় দফার পক্ষে মানুষ ঐক্যবদ্ধ। তখন কেবল ডাকের অপেক্ষা। সে ডাকের জন্য একমাত্র এবং অপরিহার্য ব্যক্তি যে বঙ্গবন্ধু, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জেল-জুলুম-হুলিয়া সবকিছুকে তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধু নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেছেন জীবনের প্রতিটি পদে সঠিক এবং সময়োচিত পদক্ষেপের মাধ্যমে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমুজ্জ্বল রাখতে জীবনের সব পদক্ষেপ হতে হয় নির্ভুল; কিন্তু একটি ভুলে জীবনের সব সুন্দর অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতেই যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন নির্ভুল এবং নির্মোহ মানুষের মূর্ত প্রতীক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাই বঙ্গবন্ধুকে এ দেশের মানুষ ২৬৯ আসনের মধ্যে ২৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন তুলে দেন। কিন্তু সেনা নিয়ন্ত্রিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সেনা শাসকরা হাঁটলেন ইতিহাসের ভুল পথে। আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হলো না। ঐতিহাসিকভাবে যা ছিল একটি মর্মান্তিক এবং চূড়ান্ত ভুল সিদ্ধান্ত। যার অনিবার্য পরিণতির ফল ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধ, একটি ভয়াবহ রক্তপাত, লাখ লাখ মুক্তিপাগল মানুষের একটি ইতিহাস গড়ার মৃত্যুমিছিল। রক্তরঞ্জিত পতাকা হাতে একটি স্বাধীনতা পেতে অদম্য মানুষের স্বৈরাচারী শাসকের হাত থেকে মুক্তি না হওয়া অবধি ঘরে না ফেরার দীপ্ত শপথ। এবং অবশেষে খোকা নামের সেই ছেলেটি যার বয়স ৫১ বছর, তার মন্ত্রমুগ্ধ ডাকে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তভেজা জমিনে লাল সবুজের পতাকা উড়ল, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা পেলাম হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সোনার বাংলা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ৫১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তিতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে 'জুলিও কুরি' উপাধিতে ভূষিত করল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন