দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বদলাচ্ছে সংস্কৃতি। পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের পুরোনো জীবনাচরণ। ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন আসছে আমাদের মানসিকতায়। এক সময়কার ফেরিওয়ালা আজ রূপ নিচ্ছে ডিজিটাল অনলাইনের ব্যবসায়ীতে। ঘরে বসে আয় ও ব্যয়ের হিসাব কষতে কষতে কখন যে আমরা সাইবার হিউম্যানে পরিণত হচ্ছি, হয়তো অনেকেরই তা অজানা। তবুও স্বস্তি, আমরা তো এগুচ্ছি।
মানসিকতার পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বাড়ছে সচেতনতাও; কমে যাচ্ছে মানসিক রোগ নিয়ে বিভিন্ন স্টিগমা। আজ আমরা মহাকাশেও বিচরণ করছি। হাঁটিহাঁটি পা পা করে আধুনিক বিশ্বের মহাসমুদ্রে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সাঁতার রপ্ত করেছি?
ভার্চুয়াল জীব হলো যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের রং-তামাশার বাইরে বাস্তব বা বৈষয়িক জগত, সমাজ, সংস্কার সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতা কম রাখেন। ওই ব্যক্তির আনন্দ, বেদনাসহ আবেগের সব উৎস এই ভার্চুয়াল জগত।
সমাজ এগুলেও এখনও অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে কুসংস্কার, অজ্ঞতা; মানসিক চিকিৎসার নিয়ে অপধারণা। যেমন- অনেকেই মনে করেন, সন্তানের সমস্যা হলে তারা নিজেরাই কাউন্সেলিং করতে পারেন। এটা এক ধরনের মিথ। কিন্তু, কাউন্সেলিং এক ধরনের পেশাগত দক্ষতা, এর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের দরকার হয়।
আবার ধরুন, সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মানসিক সমস্যা থাকলেও অনেকে মনে করেন, এটা একটু আধটু টেনশনের কারণে হচ্ছে, তেমন কিছু নয়। হ্যাঁ, আমরা বলতে পারি, যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা নিলে কোন রোগই তেমন কিছু নয়। আবার অনেকের ধারণা, শিশুরা কোমলমতি ও নিষ্পাপ, মানসিক রোগ হওয়ার কথা নয়। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশে ১৮ শতাংশের বেশি শিশু (১৮ বছরের নিচে) কোন না কোন মানসিক রোগে ভুগছে। এ রকম আরও কত পরিসংখ্যান আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
এবার আসি, সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কেমন আছে, সেই প্রসঙ্গে। এখানে আমরা জগৎ অনুযায়ী মনুষ্যজীবকে কয়টি ভাগ করতে পারি। যেমন- সামাজিক জীব, পারিবারিক জীব ও ভার্চুয়াল জীব। সহজে বোঝার স্বার্থে একটু ব্যাখ্যা করি। সামাজিক জীব বলতে আমরা বুঝি, যারা সমাজের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আচার-অনুষ্ঠান বোঝেন এবং মেনে চলেন।
পারিবারিক জীব হচ্ছে, যিনি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে অফিস আর বাসা, এই গণ্ডির বাইরে আর কিছুই তিনি ভাবেন না। আর নারীদের ক্ষেত্রে রান্না ঘর আর স্বামী-সন্তানের বাইরে তিনি আর কাউকে চিনতে চান না, বুঝতেও চান না।
আর ভার্চুয়াল জীব হলো যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের রং-তামাশার বাইরে বাস্তব বা বৈষয়িক জগত, সমাজ, সংস্কার সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতা কম রাখেন। ওই ব্যক্তির আনন্দ, বেদনাসহ আবেগের সব উৎস এই ভার্চুয়াল জগত। দল গঠন থেকে শুরু করে গাছ রোপন, সব ধরনের কাজই তারা ভার্চুয়ালি করে থাকেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা বাস্তবের সাথে সম্পর্ক রাখার সময় পান না, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
এক্ষেত্রে সমাজ বা রাষ্ট্রের বিদ্যমান অর্জন ধরে রাখার বা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কর্ণধার খুঁজে পাওয়া ভবিষ্যতে কঠিন হবে। বর্তমান তরুণ সমাজ এই ভার্চুয়াল জগতের ক্ষতির শিকার। যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে।
তবে তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ করে অভিভাবকের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করা যাবে না। তারা কিন্তু আমাদের আচরণই নিজেদের মতো করে রপ্ত করে থাকে। বিয়ে বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে যেতে যতটা তোড়জোর আমরা করি, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর শেষ বিদায়ে আমরা কি তা করি? অথচ, কেউ মারা গেলে তার স্বজনদের পাশে দাঁড়ানো সবচেয়ে জরুরি এবং তা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী আচার।
পরিণতিতে দেখতে পাই, বাবা-মায়ের মরদেহ আঞ্জুমানে মফিদুলকে দেয়া, এমনকি বাবা-মাকে হত্যা করার মতো ঘটনা। দ্বিতীয় যে বিষয়টাতে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি, তা হলো সমালোচনায় অন্যকে ছোট করার অভ্যাস বা জনসম্মুখে কাউকে অপমান, অপদস্থ করে আনন্দ পাওয়া বা নেতৃত্ব জাহির করা। তরুণ প্রজন্মের সম্মুখেই আমরা এটা করে থাকি।
এতে করে তারা আমাদের চোখের সামনেই বেড়ে উঠছে ক্ষুদ্র মানসিকতায়। পরিবর্তিত সমাজ বা জগতের সাথে তরুণ মানসিকতার যে পরিবর্তন ঘটছে, তা পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হওয়ার শামিল। মননশীলতায় সে যদি স্বাধীন না হয়, সমাজ ও পৃথিবীর সর্বোপরি নিজের জন্যও যদি কল্যাণকর না হয়, তবে সেই তরুণের কাছ থেকে অভিভাবক হিসেবে কী-ই বা আশা রাখতে পারি?
সমাজের কোন কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল জগতে বসবাসকারী তরুণদের দক্ষতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমছে যোগাযোগের দক্ষতাও। দেখা যাচ্ছে, তারা সমস্যা মোকাবেলার বাস্তবভিত্তিক পদ্ধতি অবলম্বনের চেয়ে নেতিবাচক কৌশল গ্রহণ করছে। বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা, মাদকের অপব্যবহার, সহিংসতা ও নির্যাতন।
নিজেদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সচেতন হওয়ার পর্যাপ্ত তথ্য তরুণ সমাজকে কি নিয়মিত দেয়া হচ্ছে? যদি তা না দেওয়া হয়, তবে এটাই হতে পারে তরুণদের অপরাধ প্রবণতার পূর্ববর্তী কারণ। তরুণ প্রজন্মের সুস্থ, সুখী ও প্রাণোচ্ছল জীবন যাপনে তাদের প্রয়োজনগুলোর প্রতি মনোযোগ দিন। এ লক্ষ্যে তরুণদের সাথে অভিভাবকদের নিয়মিত আলাপচারিতা জরুরি। মনে রাখতে হবে, কেবল সুস্থ তরুণরাই পরিবর্তনের বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনতে সক্ষম।
লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।
সূত্র: জাগো নিউজ
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন