দক্ষিণ কোরিয়ার ডিগু শহরে বসেছিল আন্তর্জাতিক আর্থ সায়েন্স অলিম্পিয়াডের (আইইএসও) ১৩তম আসর। এই আয়োজনে অংশ নেয় বিশ্বের ৪৩টি দেশের ১৭২ জন প্রতিযোগী। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের চার শিক্ষার্থী। তাদের মধ্য থেকে এককভাবে ব্রোঞ্জ ও বহুজাতিক দলের হয়ে স্বর্ণ জিতেছে তিনজন।
রাত প্রায় শেষ, ভোর হতে চলেছে। দলের ১০ জনের চোখই ঘুমে ঢুলু ঢুলু। তারপরও খুব কষ্ট করে চোখ খুলে কাজ করে যাচ্ছে ৩–৪ জন। বাকিদের রুমে ফিরতে বলার পরও নড়ানো যাচ্ছে না। এক টুকরো কাগজ কেটে দিতে বললে ঘুমচোখেই লাফিয়ে ওঠে, একসঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেয়। পোস্টার প্রেজেন্টেশনের এই প্রস্তুতি শেষেই হোটেল থেকে ভেন্যুতে যাওয়ার বাসে একটু ঘুমাতে পারল পুরো দল।
রাতাজাগা এমন প্রস্তুতি কিসের জন্য? ১৩তম আন্তর্জাতিক আর্থ সায়েন্স অলিম্পিয়াডের (আইইএসও) এবারের আসর বসেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ডিগু শহরে। গত ২৬ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বের ৪৩টি দেশের ১৭২ জন প্রতিযোগী অংশ নেয় এতে। এ বছর বাংলাদেশের হয়ে আইইএসও–তে অংশ নেয় ঢাকার অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাদশ শ্রেণির রুদাইবা আদনীনা, প্যারামাউন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির মো. সাদাদ ফারহান হোসেন, নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করা এ কে এম সাদমান মাহমুদ ও নারায়ণগঞ্জের চেঞ্জেস স্কুলের এ লেভেল শ্রেণির জান্নাতুল ফেরদৌস। ওদের রাতজাগা পরিশ্রম বিফলে যায়নি। শুরুতে বলে নেওয়া ভালো, এই অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে হয় একক ও দলগতভাবে। দলগুলো আবার হয় বহুজাতিক। মানে ৪৩টি দেশের প্রতিযোগীরা ৪ জন করে ১৭টি দলে ভাগ হয়। এবার একক আয়োজনে ব্রোঞ্জপদক পায় এ কে এম সাদমান মাহমুদ ও রুদাইবা আদনীনা। স্বর্ণপদকজয়ী দলেও ছিল রুদাইবা। জান্নাতুল ফেরদৌস ছিল ব্রোঞ্চজয়ী দলে।
এর আগে পাঁচবার অংশ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের অর্জন ৩টি রৌপ্যপদক ও ১০টি ব্রোঞ্জপদক।
এবারের আয়োজনের স্লোগান ছিল ‘প্যাশন ফর আর্থ সায়েন্স…কন্টিনিউড’। ইন্টারন্যাশনাল জিওসায়েন্স এডুকেশন অর্গানাইজেশন (আইজিইও)-এর বিশেষ কার্যক্রম হিসেবে ২০০৭ সাল থেকে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল–কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এতে।
একটি দল তৈরি করা হয় প্রতিটি দেশ থেকে ৪ জন অংশগ্রহণকারী আর দুজন পরামর্শকের সমন্বয়ে। ৯ দিনের এই আয়োজনে দুই ধাপের লিখিত পরীক্ষায় এককভাবে অংশ নেয় প্রতিযোগীরা। ভূতত্ত্ব, জিওফিজিকস, আবহাওয়াবিজ্ঞান, সমুদ্রবিদ্যা, ভূকেন্দ্রীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়গুলো থেকে প্রশ্ন করা হয় এই অলিম্পিয়াডে।
আগেই জেনেছেন, এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারী নিয়ে গঠন করা হয় আলাদা আলাদা দল। তাই প্রতি দলেই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পায়। প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে দলগতভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নেয় সবাই। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে সেখানকার ভৌগোলিক রহস্যের সমাধান করতে হয় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে। আর সব শেষে থাকে দলগত উপস্থাপনা। নির্ধারিত কোনো বিষয়ে দলের সবাইকে একসঙ্গে পোস্টার বানিয়ে বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়।
আন্তর্জাতিক আর্থ সায়েন্স অলিম্পিয়াডে ২০১২ সাল থেকে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ দল। জাতীয় পর্যায়ে এই অলিম্পিয়াডের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল ইনিশিয়েটিভ (বিওয়াইইআই)। দল গঠন করা হয় দেশে জাতীয় পর্যায়ের অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে, এর নাম ন্যাশনাল আর্থ অলিম্পিয়াড (এনইও) । এ বছর ‘বিশুদ্ধ বায়ু, সুপেয় পানির অঙ্গীকার, আগামী প্রজন্মের অধিকার’ স্লোগানে এই অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা হয়েছিল জুন মাসে। অনলাইন ও দেশের আটটি বিভাগে আঞ্চলিক পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের জন্য প্রতিযোগী বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী গ্রিন ডে ট্রেনিং। এরপর জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শেষে বাছাই করা হয় সেরা শিক্ষার্থীদের। তাদের নিয়ে তৈরি হয় বাংলাদেশ দল।
এ বছর বাংলাদেশ দলের পরামর্শক হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ইউনুস আহমদ খান ও বিওয়াইইআইএর প্রোগ্রাম ম্যানেজার সুদীপ্ত কুমার। জাতীয় দলের বাছাই শেষে কয়েক সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেয় নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা।
এবারের বাংলাদেশে দলের সাদমান ছিল বাকিদের চেয়ে অভিজ্ঞ। আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা আছে ওর। প্রথম দিনের লিখিত পরীক্ষা খানিকটা খারাপ হয়েছিল। কিন্তু পুরোনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে মোটেও ভুল করেনি সাদমান।
তবে বেশ কবছরের প্রস্তুতির ফলেই স্বর্ণপদক পেয়েছে রুদাইবা। ওর কথা, ‘স্কুলের সিলেবাসে এক–আধটু থাকলেও ভূতত্ত্ব নিয়ে খুব বেশি জানতাম না আমি। অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নতুন করে জানার সুযোগ হয়েছিল। এখন আমি আমার চারপাশের দুনিয়াকে এক নতুন চোখে দেখতে পারি। স্বর্ণপদকজয়ী দলে থাকতে পেরেছি বলে আমি খুব খুশি। এতে দলের বাকিদের অবদানও ছিল অনেক বেশি।’
আইইএসও–র এবারের আয়োজনে প্রতিটি দলকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় এক জাদুঘরে। নানা রকম পাথর ও মাটির নমুনা পরীক্ষা করে সেখানকার ভৌগোলিক ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হয় প্রতিযোগীদের। এসব নমুনা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে পৃথিবীর গঠন বোঝা সম্ভব। এ ধরনের হাতে–কলমে করা কাজে বেশ পটু ছিল সাদাদ ফারহানের দল। ওর দলের বাকিরা ছিল এশিয়ার। তাই নিজের দল নিয়ে একটু বাড়তি গর্ব ওর। দলগত পর্যায়ে কোনো পদক না এলেও নিজের সেরাটা দিয়ে এককভাবে ব্রোঞ্জপদক পায় ও।
পুরো দলকে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল অবশ্য জান্নাতুল ফেরদৌসের হাতে। আইইএসও–তে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে ও বলল, ‘শুরুতে দলের কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব। তবে প্রতি রাউন্ড পার হতেই একে একে সবাই কাজ শুরু করে। আমাদের সবাইকে শেষ দিনে “টাইফুন” নিয়ে পোস্টার প্রেজেন্টেশন বানাতে বলা হয়। ওই কাজের সময়ই দলের বাকিদের বন্ধু বানিয়ে ফেলি আমি।’
বাংলাদেশ দলের এই অর্জন নিয়ে ন্যাশনাল আর্থ অলিম্পিয়াডের সহ–আহ্বায়ক ইউনুস আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতির সময় বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতে যেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীদের আমরা সুযোগ করে দিতে পারি সে চেষ্টাও থাকবে।’
শুধু প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আনন্দ নয়, বাংলাদেশ দলের সদস্যরা সারা বিশ্বের নানা সংস্কৃতির কিশোর–তরুণদের সঙ্গে বন্ধু পাতাতে পেরে খুব খুশি। বড় হয়ে দেশের পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে চায় ওরা। সমাপনী দিনে প্রত্যেককে দেশের হয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নিতে হয়। বাংলাদেশের হয়ে নাচে–গানে মঞ্চ মাতিয়েছে নবীন পরিবেশবিদেরা। তবে ওরা যখন বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে কাজ করবে তখন নিশ্চয়ই আরও ভালো থাকব আমরা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন