টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শৈশবে এক পায়ের চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সাদেকপুরের ছেলে ওমর ফারুক। তারপর থেকেই মানুষের কাছ থেকে 'প্রতিবন্ধী' কথাটি শুনতে হয় তাকে। প্রায় সময়েই অবহেলিত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকেও। কিন্তু থেমে যাননি। থেমে যায়নি তার স্বপ্ন দেখাও। শত বাধা উপেক্ষা করে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণায় নিজেকে সেসব অবহেলা, বঞ্চনার ঊর্ধ্বে রেখেছেন তিনি।
তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বাবা-মায়ের বড় সন্তান ওমর ফারুক। তাদের সুখে-শান্তিতে রাখতে বছরের পর বছর বিদেশে থাকেন তার বাবা। কিন্তু টাইফয়েডের কারণে নিজের চলার শক্তি হারিয়ে ফেলায় অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন তার বাবা-মা। হাল ছাড়েননি তবুও। সাহস জুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত। ফারুক বলেন, 'লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের 'অদম্য ফাউন্ডেশন' থেকে প্রশিক্ষণ নিই। বর্তমানে ডাটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডে কাজ করছি।' ভবিষ্যতে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে দেখতে চান স্বপ্নবাজ এই তরুণ।
ওমর ফারুকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড শারীরিকভাবে সক্ষম নন, এমন আরও চার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে আরেকজন ইমাম হোসেন। দুই বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে পায়ের সমস্যা দেখা দেয় তারও। পরে তিনি আশপাশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, শারীরিকভাবে কোনো সমস্যা হলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সেগুলো যেন বাধা হয়ে না আসে তার জীবনে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি খুঁজে নিয়ে একসঙ্গে চালিয়ে গেছেন দুটোই। ওয়েব ডিজাইনিংয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ক্ষেত্রগুলোয় কর্ম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইমাম হোসেন এখন কাজ করছেন কন্ট্যাক্ট সেন্টার এক্সিকিউটিভ হিসেবে। জীবনের প্রতিটি ধাপে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ইমাম হোসেন নিজ যোগ্যতায় নিজেকে খুব বড় এবং সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।
ওমর, ইমামের মতো জন্মগতভাবে বা দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতায় পায়ের সমস্যা নিয়ে বাচ্চু, সালমা, শাহীনার জীবনসংগ্রামের গল্পও ব্যতিক্রম নয়। কন্ট্যাক্ট সেন্টার এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত মোহাম্মদ বাচ্চু হোসেন হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জন্মের পর থেকেই পায়ে সমস্যা ছিল তার। সেটিকে কখনোই বাধা মনে করেননি তিনি। সেই সমস্যা সঙ্গে নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। বর্তমান কর্মস্থলে যোগদানের আগে একটি প্রতিবন্ধী সংস্থার হিসাব বিভাগে চাকরি ও একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। হিসাববিজ্ঞানে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মোহাম্মদ বাচ্চু হোসেন সে বিষয়েই তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চান।
প্রতিদিনের মতোই ভার্সিটির ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সালমা আক্তার। পথিমধ্যে রাস্তায় পিছলে পড়ে পায়ে আঘাত পান তিনি। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে সেই আঘাত বড় আকারে রূপ নেয় এবং একসময় স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা। চিকিৎসা চলাকালে অসহনীয় সেই ব্যথা নিয়েই ভার্সিটির পরীক্ষায় বসেন তিনি এবং পরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সম্মানজনক ফল নিয়ে বের হন। তারপরও বিরতি পড়েনি তার এগিয়ে যাওয়ার পথে। চিকিৎসার পাশাপাশি কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এখন ডাটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবে কাজ করছেন।
ছোটবেলা থেকে পায়ে একটা সমস্যা নিয়ে বড় হওয়া, বর্তমানে কন্ট্যাক্ট সেন্টার এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত শাহিনা খাতুন স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এর আগে তিনি ব্র্যাকের শিক্ষা বিভাগে স্টাফ ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। পরিবারের খরচ বহনে স্বামীকে সহায়তা করার পাশাপাশি নিজের সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করে চলেছেন এই সংগ্রামী নারী।
তারা এখন একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, একে অন্যের সহকর্মী হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ওমর, ইমাম, বাচ্চু, সালমা, শাহীনার মতো এমন অনেক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের আশপাশে। বিভিন্ন কারণে তাদের ওপর থেকে দৃষ্টি সরে যাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধাবঞ্চিত হতে হয় তাদের। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও হতে হয় সমস্যার সম্মুখীন। সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের আলাদা ভেবে নেওয়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে। যে দৃঢ় মনোবল, পরিশ্রমের সঙ্গে তারা তাদের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই মনোবল ও পরিশ্রম প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি কর্মীর ভেতর থাকা প্রয়োজন।
আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের হিউম্যান রিসোর্সেসের এজিএম মো. সাঈদ ইকবাল বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির চিন্তাভাবনা ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করার। সেই তাগিদ থেকেই এই পাঁচ তরুণ-তরুণীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে আইপিডিসি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও উচিত এমন উদ্যমী, পরিশ্রমী ও সংগ্রামী মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। কেননা, জনশক্তির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহারই দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তুলতে পারবে।' সমকাল
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন