এক
মানুষ মাত্রই স্বপ্ন আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে; ব্যর্থতা আছে, হতাশা আছে। গুণিজনরা বলে থাকেন যে, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। যাঁর স্বপ্ন যত বড় হয়, মানুষ হিসেবে সে তত বড় হয়। একবিংশ শতাব্দির একদল উদ্যমী স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী ইতঃমধ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মানুষ শুধু তাঁর স্বপ্নের সমান বড় নয়; বরং ইচ্ছে করলে একজন মানুষ তাঁর স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যেতে পারে অর্থাৎ স্বপ্নের চাইতেও বড় হতে পারে। অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান, বিশ্বজয়ী ক্বারী হাফিজ নাজমুস সাকিব ও হাফিজ তরিকুল ইসলাম, এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহিম, এম এ মুহিত, নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজনীন, রন্ধনশিল্পী টমি মিয়া এবং বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান প্রমুখ এর জীবন্ত উদাহরণ। এরা সবাই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা; কিন্তু কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য আর কর্মদক্ষতায় তাঁরা অসাধারণ মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, স্বপ্নবাজ তরুণদের আইডল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাঁদের এই সাফল্যগাঁথা পথ আদৌ মসৃণ ছিল না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অধ্যবসায়ের ফসল সাফল্য বা সফলতা নামক এই সোনার হরিণ। বিপদসঙ্কুল পরিবেশ ও ব্যর্থতায় তাঁরা হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়েনি কিংবা হাল ছেড়ে দেয়নি। কোনো সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বাঁধা তাঁদের স্বপ্ন হতে বিচ্যুত করতে পারেনি। যে পথিক জানে তাঁর গন্তব্য কোথায়, সে পথিক কখনো পথ হারায় না। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে সময়ের তারতম্য হতে পারে; ক্ষেত্রবিশেষে তারতম্য হওয়াটা স্বাভাবিক। অনেকে সময়ের এই তারতম্য মেনে নিতে পারে না। ফলে সময় জ্ঞানহীন স্বপ্নবাজদের নির্ঝরে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আবার, বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্নও ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ। আর ব্যর্থতা থেকেই হতাশা নামক ব্যাধির উৎপত্তি। বাস্তবতা নিরিখে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ড. এপিজে আবুল কালামের বিখ্যাত উক্তি, স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখো; স্বপ্ন সেটা, যেটা তোমায় ঘুমোতে দেয় না। নেটিজেন/ডটকম দুনিয়ার স্বপ্নবাজ তরুণরা সারা রাত জেগে স্বপ্ন বুনে আর দিনে ঘুমিয়ে স্বপ্ন মঞ্চস্থ করে। সুতরাং শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তজ্জন্য প্রয়োজন কঠোর সাধনা আর দৃঢ় প্রত্যয় ও মনোবল। আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যর্থতা হলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর সিঁড়ি মাত্র। ব্যর্থতা ছাড়া সফলতা আসেনা, কালেভদ্রে আসলেও তা কখনো টেকসই হয় না। আমাদের মহান স্বাধীনতা স্বপ্নেরই ফসল। যে স্বপ্ন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক দেখতে সাহস করেননি; শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশে সে স্বপ্ন মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেখেছিলেন এবং এরই ধারাবাহিতায় ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের তাজা রক্ত, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম এবং এক কোটির অধিক শরণার্থীর অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
দুই
ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক ও বিপদ-আপদ মানব জীবনের স্বাভাবিক ও চলমান অনুষঙ্গ। এই সবকিছুর মধ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আ'লামিন কল্যাণকর ও শিক্ষণীয় কিছু বিষয় লুক্কায়িত রেখেছেন। যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা ও বাস্তবসম্মত জ্ঞানের অভাবে যা আমরা অনুধাবন করতে পারি না। অনেকক্ষেত্রে অনুধাবন করার চেষ্টাও করি না। মহাগ্রন্থ আল-ক্বুর'আনে বর্ণিত হযরত আইয়ূব (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত হাযেরা (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত আছিয়া (আঃ), হযরত মারঈয়াম (আঃ) এবং হযরত ঈসা (আঃ) সহ অসংখ্য নবী-রাসুলের জীবনচরিত এর অনন্য উদাহরণ। এরই ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে জন্ম নেওয়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সফল ও খ্যাতিমানদের জীবনচরিত তারই সাক্ষ্য বহন করে। এজন্যই জ্ঞানীরা সফল ও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জীবনী অধ্যয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রকৃত ধর্মীয় ও বাস্তবসম্মত শিক্ষালাভ এবং বন্ধুবৎসল পারিবারিক কাঠামো এইসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়।
আত্মহত্যা কিংবা মাদকদ্রব্য সেবন বা টেনশন কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমস্যার সৃস্টি করে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আত্মহত্যা কিংবা মাদক সেবন করে নিজের স্বপ্নকে তিল তিল করে ধ্বংস করার কোন মানে হয় না। প্রকৃত স্বপ্ন কখনো মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয় না; দিতে পারে না। ব্রায়ান ডাইসনের ভাষায়, স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাইবলে, স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়, স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে চলো। স্বপ্ন ছাড়া জীবন অর্থহীন।
শত-সহস্র ব্যর্থতা ও শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশ স্বত্বেও স্বপ্নবাজরা কখনো পরাজয় শিকার করে না কিংবা হতাশ হয়ে পড়ে না বা ধ্বংস হয়ে যায় না। বরং ব্যর্থতা বা পরাজয়ের গ্লানির মধ্যে ফিনিক্স পাখির ন্যায় বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে বেড়ায়। যা তাঁকে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের মনে রাখা উচিত, ব্যর্থতা বা পরাজয় মানে নিঃশেষ কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়; বরং নির্দিষ্ট লক্ষপানে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া। আমরা সকলেই জানি, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ্ পাক এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন আমাদের জন্য। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে পশুর মতো আচরণ আমাদের মানায় না। শুধু নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা চিন্তা না করে পরের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া উচিত। এটা জগৎ খ্যাত সফল মানুষদের সফলতা লাভের অন্যতম টনিক। নিজের সুখ আর স্বার্থের কথা যাঁরা চিন্তা করে, প্রকৃত অর্থে, তাঁরা স্বার্থপর। এদের দ্বারা মানবতার কোনো কল্যাণ সাধিত হয়নি, হবেও না।
তিন
ডটকম ওয়ার্ল্ডের স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীদের নিকট সফলতা মানে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন আর যশখ্যাতি কামানো। আবার, অনেকের কাছে সফলতা মানে ভালো ফলাফল, ভালো ফলাফল মানে ভালো চাকুরি, ভালো চাকুরি মানে ভালো বেতন। এক্ষেত্রে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কর্পোরেট জগতের এই অতি আধুনিক ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করছে বলা যায়। ফলে সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার শিখনফল সমাজ ও রাষ্ট্র ভোগ করতে পারছে না এবং পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। নষ্ট হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যিক সম্পর্কের সুদৃঢ় বন্ধন।
অর্থ আমাদের প্রয়োজন, অর্থের অনস্বীকার্যতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ অর্থকে ঘিরে আমাদের সুখকল্প/স্বপ্ন আবর্তিত হয়। তাইবলে এই নয় যে, অর্থই সকল সুখের মূল কিংবা অর্থই সফলতার একমাত্র মাপকাঠি। আবার, এটাও বলা উচিত নয় যে, অর্থই সকল অনর্থের মূল। কারণ অনেকসময় অর্থাভাবই সকল অনর্থের মূল হয়ে দাঁড়ায়।
চার
আল্লাহ সব মানুষকে বিশেষ কিছু গুণাবলি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কর্মের মধ্যদিয়ে মানুষ নিজের গুণাবলিগুলোকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ নিজের ক্ষমতা বা সক্ষমতা নামক রহস্য উদঘাটন করতে পারে না। ফলে পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা তাঁর মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। অন্যের সফলতা বা অর্জনকে সে নিজের ব্যর্থতা মনে করে তা মেনে নিতে পারে না। ভঙ্গুর পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত চাকুরিমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।
রাষ্ট্রের মহামূল্যবান সম্পদ নতুন প্রজন্মের স্বপ্নসারথিদের বলবো, নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের গুরুত্ব বুঝার চেষ্টা করো। নিজেকে মূল্য দিতে শিখো। পজিটিভ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হও। বিবেকবর্জিত আবেগ আর অতি প্রাকৃত স্বপ্ন পরিহার করে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করো। নিজেকে ভালবাসতে শিখো। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চেষ্টা করো। বিদ্যা অর্জনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দাও। সৎ, সত্যবাদী ও সৎ সাহসীকে বন্ধু/সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করো। জীবনে চলার পথে সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পারিক সম্মানবোধকে প্রাধান্য দাও। হে নতুন দিনের লড়াকু সৈনিক, উপর্যুক্ত বিষয়গুলিকে জীবনে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে মেনে চলো। ব্যর্থতা আর হতাশার শৃঙ্খল তোমাদের কখনই কাবু করতে পারবে না। তুমি সফল হবে, সুখপাখি তোমাকে স্বেচ্ছায় ধরা দেবে।
সর্বোপরি, নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে সুখস্বপ্ন/সুখকল্পের কবর দিও না। তোমাকে বাঁচতে হবে, তোমার বেঁচে থাকা উচিত; তোমার স্বপ্নই তোমাকে এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখতে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগাবে, তোমাকে অমরত্ব দান করবে। কীর্তিমানের যেমন মৃত্যু নেই, স্বপ্নেরও তেমন মৃত্যু নেই। আর নির্ঝরে যে স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বা যে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে, বাস্তবিক অর্থে সে স্বপ্ন স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন; কারণ স্বপ্নের মৃত্যু নেই, মৃত্যু হতে পারে না।
মানুষ স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে না; বরং স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
আগামির নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য স্বপ্নবাজ তরুণদের অগ্রযাত্রা নিরাপদ হোক- এই প্রার্থনা ও প্রত্যাশায়.......;
লেখকঃ প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান বিভাগ), ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজ, কুলাউড়া, সদস্য, সিলেট ডিস্ট্রিক ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন