১.
প্রকাশ্যে দিনের আলোয় জলজ্যান্ত একটি তরুণকে দলবেঁধে একদল তরুণ কুপিয়ে হত্যা করছে এমন রোমহর্ষক দৃশ্য কোনো স্বাভাবিক মানুষ দেখলেও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা কিন্তু আমরা তা হই না। কারণ আমরাও অসুস্থ। যারা সংঘবদ্ধ হয়ে এই অপরাধ করছে তারা উন্মাদ, অমানুষ, বর্বর, ভয়ঙ্কর অপরাধী বটে, দর্শক হিসেবে আমরাও মানসিকভাবে অসুস্থ নই কি?
আর এই অসুস্থতা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে, সারা দেশে। আমরা গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারা প্রতিদিন হত্যা, খুন, জখমের খবর কম্পাইল করতে করতে ক্লান্ত, অসুস্থ বোধে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, সংক্রামক হচ্ছে ব্যাধি।’ আমরা সেই ব্যাধিকে সংক্রামক হতে দেখছি আমাদের সমাজে প্রতিদিন। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি প্রতিদিন খুনিরা অভিনব কায়দায়, অভিনব পদ্ধতিতে একের পর এক খুন করে চলেছে। ফেনীর নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে, শরীরে কেরোসিন ঢেলে, আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে।
চিহ্নিত এক সন্ত্রাসীর প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাসীর সহযোগীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করার পর সেই হত্যাকাণ্ডকে আবার ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার সমস্ত আয়োজনও করা হয়েছে। এমনকি খুনিদের পক্ষে আদালতে এ সাফাই গেয়েছে খুনিদের আইনজীবী পর্যন্ত।
একইভাবে বরগুনায় রিফাতকে প্রকাশ্যে হত্যাকারীরা ফেসবুকে চরিত্রহনন করছে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির। দুর্জনের ছলের প্রয়োজন হয়। দুর্বৃত্তের প্রয়োজন হয় মিথ্যার। খুনের যে বহ্ন্যুৎসব চলছে তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। রিফাত হত্যার রক্তের দাগও শুকায়নি সাতক্ষীরার কেশবপুর মঙ্গলকোটের অটোরিকশাচালক শাহীনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে তার রিকশাটি ছিনতাই করে নিয়ে গেছে খুনিরা। মাত্র ১৪ বছরের একটা ছেলে যে তার অভাবের সংসারের ভার গোটাটাই তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে।
তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনটি ছিনিয়ে নিতে খুনিরা যাত্রী সেজে তার রিকশা ভাড়া করেছিল। শাহীন এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে। সংজ্ঞাহীন হওয়ার আগে শাহীনের শেষ বাক্য- ‘এত করে কলাম আমারে মারিস না।’ ওরা কয়, ‘তোর নিস্তার নেই।’
খুনিদের বলা শব্দ তিনটি যেন সব খুনির জবানবন্দি তাদের শিকারদের উদ্দেশে- ‘তোর নিস্তার নেই।’ যেন সারা দেশে উন্মত্ত খুনিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ‘নিস্তার নেই’, ‘নিস্তার নেই।’ এই নিয়তি আজ শুধু নুসরাত, রিফাত শাহীনের নয়, আপামর জনতার।
আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এই বাংলাদেশের জন্য কি ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই নয়। কোথায় চলেছি আমরা পরস্পরকে হনন করে? আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- ‘ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম/প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।’
প্রেমে রাজি না হওয়া কন্যাকে পুড়িয়ে মেরে না প্রেমের দেখা মেলে; না থাকে সুখ- এই বোধোদয় কি খুনিদের ঘটেছে? ঘটেনি যে তা বোঝা যায় আদালতে সাক্ষী দিতে এসে তাদের যে আস্ফালন নিহত নুসরাতের পিতা ও ভাইয়ের প্রতি- তা থেকে। না কোনো অনুতাপ, না কোনো অনুশোচনা- এসব তাদের কারও মধ্যেই দেখা যায় না।
অর্থাৎ মনুষ্যত্বের কোনো বোধ এই খুনিদের মাঝে নেই। কাউকে খুন করলে তার পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সর্বোপরি দেশের মানুষের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা উপলব্ধির শর্ষেদানা পরিমাণ বোধ তাদের আছে বলে মনে হয় না। আর তা নেই বলেই আমরা দেখি যে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি জামিনে ছাড়া পেয়ে বের হয়েই আবার থানায় গিয়ে হাজির হয় জ্যান্ত মানুষের মুণ্ডু কেটে নিয়ে! এমন নৃশংসতা এ দেশে ঘটছে।
২.
কোথায় চলেছি আমরা? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। খাদ্যপণ্যের যেটাতেই হাত রাখা যায়, সেটাতেই ভেজাল। যেন মৃত্যু আমাদের চতুষ্পার্শ্বে ফাঁদ পেতে বসে আছে জীবনের মূল্য হ্রাসের ঘোষণা জানিয়ে। হাইকোর্টের ভেজালবিরোধী রায়ে বিচারপতি জানিয়েছেন- ‘দেশটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।’ এত রক্ত, এত আত্মত্যাগে আমরা কি এই দেশ অর্জন করছিলাম?
আমেরিকান কবি মায়া অ্যাঞ্জেলুর মতে, ‘আমরা যখন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলি, তখনই আমাদের চূড়ান্ত মৃত্যু হয়।’ মৃত্যুকে চমৎকারভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি।
কবির মৃত্যুর সংজ্ঞা অনুযায়ী এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি বর্তমানে আমরা এক ‘মৃত সমাজে’র বাসিন্দা মায়া অ্যাঞ্জেলুর মতোই আরও তীব্র ও তীক্ষ্ণ উপলব্ধিতে মৃত্যুকে বর্ণনা করেছিলেন আমাদের প্রাজ্ঞ ঋষি বিবেকানন্দ। তিনি লিখেছিলেন- ‘পরোপকারই জীবন, পরহিত চেষ্টার অভাবই মৃত্যু। জগতের অধিকাংশ নরপশুই মৃত প্রেততুল্য; কারণ হে যুবকবৃন্দ যাহার হৃদয়ে প্রেম নাই, সে মৃত; প্রেত বই আর কি?’
বর্বরতা, নৃশংসতার সূত্রে মনে আসা উপর্যুক্ত গান কিংবা দার্শনিক উক্তির উদ্ধৃতি উল্লেখ মাত্র। বাস্তবতাকে উপলব্ধির প্রয়াস। মানুষের অমানবিকতার নেপথ্যের কারণগুলো কী- তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কোন বাস্তবতার গর্ভ থেকে জন্ম নিচ্ছে ‘দুলালে’র ঘরে আলালেরা তার স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে। না হলে এই খুনিদের দায়ের কোপ থেকে কোনোভাবেই আমাদের ‘নিস্তার’ লাভের সম্ভাবনা নেই!
আমরা অতীতের খুনি ইমদু’র কথা জানি- মানুষের কাটামুণ্ডু নিয়ে যে কিনা ফুটবল খেলত। আমরা জানি খুনি এরশাদ শিকদারের কথা। যে প্রতিটি খুনের পর দুধ দিয়ে গোসল করত পবিত্র হওয়ার জন্য। আমরা তাদের শেষ পরিণতিও জানি। ফাঁসির কাষ্ঠে এদের মৃত্যু সত্ত্বেও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না নুসরাত, রিফাত, শাহীনের খুনিদের উদ্ভব? প্রশ্ন সেটাই।
৩.
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আমাদের শৈশবেই একফোঁটা রক্ত দেখলে আমরা আতঙ্কিত হতাম। ঘাবড়ে যেতাম। আর এখন বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের ভিডিও অপশনে গিয়ে ভিডিও করি। তারপর সেটা নেটে ছেড়ে দিই।
আগে যে কেউ আক্রান্ত হলে মানুষ আগে আক্রান্ত মানুষটিকে রক্ষা করতে এগিয়ে যেতেন। রক্ষা করতেন প্রাণ; তারপর বিচার-আচার। আর এখন কোনো এলাকায় অচেনা একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিংবা মানসিক রোগীকে ঘুরতে দেখা গেলে ‘চোর সন্দেহে’ পিটিয়ে মারার কর্মযজ্ঞে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণখুনের উৎসবে মেতে ওঠে।
টাকার লোভে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করছে আত্মীয়স্বজন তথা আপন মানুষরা। এমনই ঘটছে; কারণ আমরা একে অপরের ওপর শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা প্রেতলোক নির্মাণ করে বসে আছি নিজের অজান্তেই।
এই প্রেতলোক থেকে মুক্তির উপায় কী? উপায় মানবিক মূল্যবোধের জগতে ফিরে যাওয়া।
৪.
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার উদ্ভাবন মানবকল্যাণের লক্ষ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা সেটা ব্যবহার করছি বিপরীত কর্মে। আমরা তাকে চূড়ান্তভাবে অকল্যাণকর কাজে ব্যবহার করছি। যার নিট রেজাল্ট বর্তমানে দেশের এই সামাজিক নৈরাজ্য।
প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে খুনিরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে, প্রশ্নফাঁস করছে, যার যা ইচ্ছা-খুশি পূরণ। এই ইচ্ছা-খুশির বিকৃতি থেকে উদ্ভব ঘটছে বর্বরতার, নৃশংসতার।
‘মাদকাসক্তি’র সঙ্গে এখন ‘নেট আসক্তি’কে ‘ভার্চুয়াল আসক্তি’রূপে শনাক্ত করা যাচ্ছে। ‘নেট আসক্তি’ ‘মাদকাসক্তি’র চেয়েও ভয়াবহ এবং ক্ষতিকর বলে অনুভূত হচ্ছে।
আমরা শিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক মঞ্চ। তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি বইয়ের বোঝা আর জিপিএ ফাইভের দৌড়। আর তার হাতে তুলে দিয়েছি আদর করে অত্যাধুনিক ‘স্মার্টফোন’ যা কিনা বড়রাই ভালো করে ব্যবহার করতে পারি না, শিশুরা সেটা চালাচ্ছে দুরন্ত অশ্বের গতিতে।
শুধু তাই নয়, তারা পরবর্তী প্রজন্মের দ্রুতগতির স্মার্টফোনের জন্য মানসিকভাবে তৃষ্ণার্ত বুভুক্ষু হয়ে থাকছে কখন সেটা বাজারে আসবে আর তারা তাতে খেলবে ভার্চুয়াল গেম ব্লু হোয়েল, অ্যান্ড গেম ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের অগোচরে আমাদেরই প্রশ্রয়ে এটা ঘটছে। আবার এর জন্য প্রয়োজনীয় দণ্ডও দিতে হচ্ছে আমাদেরকেই। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সন্তানদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসূত্র। পরিবারের ভেতরেই সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোক্তা ও জোগানদাতার। বলা যায়, নিজের অজান্তেই আমরা ভার্চুয়াল প্রেতলোক রচনা করে বসে আছি।
এই প্রেতলোক থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের সন্তানদের খেলার মাঠগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। নাটক ও গানের মঞ্চগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে শিশু-কিশোরদের সেসব সংগঠন- ‘চাঁদের হাট’, ‘খেলাঘর’ ‘কচিকাঁচার আসর’- যেখানে পরিবারের বাইরে আরেকটি পরিবারের শিশুদের সঙ্গে ভাইবোনের মতো বেড়ে উঠত তারা।
গান করত, নাটক করত, আবৃত্তি করত, আঁকা শিখত, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সুস্থ ও সৃজনশীল জীবনযাপন করত। তারা এগিয়ে যেত বন্যাপীড়িত মানুষের পাশে। শীতার্ত মানুষের পাশে, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে। তারা বেড়ে উঠত মানবিক সাহচর্যে।
৫.
আমরা ভুলে গেছি শিশুদের কথা, তাদের গড়ে তোলার কথা। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি মূল্যবান উপদেশ আছে; তা হচ্ছে- ‘বড়দের শ্রদ্ধা করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এমন লোক আমার উম্মত নয়।’ শ্রদ্ধা আর আদরের এই যোগসূত্রকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বলেই মানুষ হত্যা, নারী হত্যা, শিশুহত্যার এমন ক্রমবিস্তার ঘটছে।
প্রায়ই আমরা এ কথা শুনি ‘উন্নয়নের জন্য’ বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ‘বস্তুগত উন্নয়নের’ সেই সিংহভাগ বরাদ্দ মোটেই ফলপ্রসূ হবে না, কাজে আসবে না- যদি আমরা মানব উন্নয়নের লক্ষ্যে শিশু ও নারীদের জীবনমান সাংস্কৃতিক চেতনা উন্নয়নের পেছনে বাজেটে বরাদ্দ না বাড়াই।
শিশুর অন্তরে থাকা ‘শিশুর পিতা’টিকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে আমাদের কারোরই ‘নিস্তার’ নেই- রক্তাক্ত নিয়তি এড়ানোর সাধ্য নেই।
সাইফুল আলম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যুগান্তর ও সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন