বুয়েট শিক্ষক সুকর্ণ বড়ুয়া ’র কিছু কথা
বুয়েট এর সহকারী অধ্যাপক সুকর্ণ বড়ুয়া ২০০৯ সালে বুয়েটের সকল বিভাগ এর সম্মিলিত ফলাফলে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং এই সম্মানে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এর হাত থেকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণ পদক’ পান। আজকের গুণীজনের কথায় থাকছে এই মেধাবী মানুষটির সাক্ষাতকার।
জন্ম ও পরিবার:
কর্ণফুলি নদীর পাড়ে চট্টগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়িতে তার জন্ম। পিতা ব্যবসায়ী সুভাষ বড়ুয়া এবং মাতা শিখা বড়ুয়া। এক বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় বোন বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত এবং বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। স্ত্রী অনন্যা বড়ুয়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করছেন।শৈশবটা কেটেছে চট্টগ্রামেই। প্রায়ই যেতেন কর্ণফুলির নদীর পাড়ে, জেটিতে বাঁধা জাহাজে উঠে পড়তেন বড় ভাই-বোনের সাথে। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছোটবেলায় তিনি ডানপিটে ছিলেন না, তবে রাজ্যের সব প্রশ্ন ভর করত তার মাথায়। জানার আগ্রহ এবং পারিবারিক পরিবেশে ছোটবেলা থেকেই বড় ভাই-বোনের মত মেধাবী হয়ে ওঠেন।
শিক্ষা জীবন:
২০০১ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে জিপিএ ৪.৬৩ (৪র্থ বিষয় ছাড়া) পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি তে চট্টগ্রাম বোর্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ জিপিএ ৪.৮০ পেয়ে পাশ করেন। এরপর বুয়েটে ভর্তি হন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে।বিশ্ববিদ্যালয় গোল্ড মেডেলিস্ট সুকর্ণ বড়ুয়া এমএসসি করেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে। এমএসসি তে তার গবেষনার বিষয় ছিল “Improving Classifiers Performance on Imbalanced Data Set”। বিভিন্ন বাস্তব সমস্যায় ডাটা সেট নিয়ে কাজ করার সময় দেখা যায়- যে দুটো গ্রুপে আমরা ডাটাগুলোকে আলাদা করতে চাই, সেখানে একটি গ্রুপের ডাটার পরিমাণ অনেক বেশি আর অন্য গ্রুপের ডাটার পরিমাণ অনেক কম হলে, বিদ্যমান ক্লাসিফায়ার গুলো ভাল ফলাফল দিতে পারে না। সুকর্ণ বড়ুয়া স্যারের গবেষনা ছিল এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কৃত্তিমভাবে কিছু ডাটা সেট তৈরী করে কিভাবে ক্লাসিফায়ারগুলো এক্ষেত্রে আরও ভাল ফলাফল দিতে পারে।গবেষণা পত্রটি IEEE Transactions on Knowledge & Data Engineering এবং PAKDD (Pacific Asia Conference on Knowledge Discovery and Data Mining) এর মত বিশ্বখ্যাত জার্নাল এবং কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে উক্ত গবেষণা পত্রের উপরে গবেষনা করেই বিশ্বের বিভিন্ন জন আরও কাজ করেন। বর্তমানে এর পাশাপাশি তিনি “Special Query Processing” এর উপর গবেষনা করছেন।
কর্মজীবন:
বর্তমানে তিনি বুয়েটের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপশি তিনি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক-এ স্বল্পকালীন শিক্ষক হিসেবেও অধ্যাপনা করছেন। এছাড়াও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। এই কৃতী মানুষটির সাক্ষাতকার সরাসরি তুলে ধরা হলঃ
আপনার স্কুল এর সময়, কলেজ এর সময় এবং বুয়েট এর সময় এর মধ্যে কোনটার অনুভূতি কেমন আপনার কাছে?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : বেশিরভাগের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ভাল লাগলেও আমার হয়েছে উল্টো। স্কুল ও কলেজ জীবনে পারিবারিক নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকলেও অনেক বন্ধু পেয়েছিলাম, ক্লাশের পরিমাণ ছিল কম, আড্ডা ছিল বেশি, পড়াশোনাও করেছি কম। ভাল স্মৃতি আছে অনেক। বুয়েটে এসে পারিবারিক স্বাধীনতা পেয়েছি একদিক থেকে ঠিকই কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রতি সপ্তাহে ৩/৪টা ল্যাব, পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট মিলিয়ে পড়াশোনার চাপে আমার আসলে একঘেয়েই লেগেছে। সেরকম ঘোরাঘুরি কখনও হয়নি।
ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলেন কেন?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : আসলে অনেকটা বাবা-মা’র ইচ্ছাতেই ইঞ্জিনিয়ারিং এ আসা। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে গণিত ভাল লাগতো খুব। এজন্য মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েও সেখানে ভর্তি হইনি। আর, ইঞ্জিনিয়ারিং এ ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর সুযোগ আছে- এসবই।
বাবা-মা’র প্রসঙ্গে আসি। দেখা যায় বাবা-মা রা তাদের অভিজ্ঞতার কারণে সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় পড়াশোনার বিষয়টি ছোটবেলা থেকেই অনেকটা চাপিয়ে দেয়। পড়াশোনার বিষয় কি সন্তানের আগ্রহের উপরে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : এখানে আসলে দুটো বিষয় আছে। সন্তান যে বয়সে এ সিদ্ধান্তগুলো নিবে, তখন তার বয়স পরিপক্ক হয়নি। একটা ছেলে হয়তো ক্রিকেটটা ভালই খেলে, কিন্তু ক্রিকেট খেলে আসলেই সে জাতীয় দলে ঢুকতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। বাবা-মা সন্তানের জন্য সে বিষয়টিই খুঁজে থাকেন যেখানে সন্তানের ভবিষ্যতে ভাল করার ঝুঁকি কম। আসলে সিদ্ধান্তগুলো নির্ভর করে বাবা-মা ও সন্তানের বোঝাপড়ার উপর। সন্তানের সাথে বাবা-মা’র সম্পর্ক ভাল হলে দুজনে বসে যুক্তি-তর্ক দিয়ে বিষয় বাছাই করা অনেক সহজ হয়। শুধু যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত তা তো নয়। বর্তমান যুগে এসে অবশ্য বাবা-মা’র ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের আগ্রহকে প্রাধান্য দেয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মনোভাব কি?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে, এটা সবাই জানে। আমাদের শিক্ষকের সংখ্যা যেমন কম, শিক্ষকরাও তেমন আপ-টু-ডেট না। গ্রামাঞ্চলে ভাল শিক্ষকের খুব অভাব। অথচ সবচেয়ে মেধাবী, ভাল শিক্ষকদেরকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা উচিৎ ছিল, কেননা এ জায়গাটাই ছাত্র-ছাত্রীদের মন ও মনন বিকাশের উৎস। এজন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চাইতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন বেশি দেয়া হয় তাতেও আমার আপত্তি নাই। কারণ আমি দেশের মানুষের টাকাতেই পড়াশুনা করেছি, আমারও দায় আছে দেশের প্রতি।
আবার আমাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি- উচ্চ বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতেই বড় ৩টি পরীক্ষা দিতে হয়। সেই সাথে আছে সেমিস্টার প্রতি ক্লাশ টেস্ট, ফাইনাল, মডেল টেস্ট- কত শত পরীক্ষা! এখন তো প্রথম শ্রেণীর ভর্তি হতেও একটা বাচ্চাকে রীতিমত যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হয়। এত পরীক্ষা যেখানে থাকে সেখানে একজন ছাত্র মুক্তচিন্তা করবে কখন, সে পাঠ্যপুস্তকের বাহিরের বই পড়বে কখন! এভাবে বিরাট চাপে থাকার কারনে ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক বিকাশ যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি তারা মুক্তচিন্তা করার মত সুযোগই পায় না।
এবং আমাদের এই নিত্য নতুন শিক্ষা ব্যবস্থাগুলোর কোনটারই কিন্তু গবেষনা করা হয়নি। গবেষণা করে বের করা হয়নি যে সিস্টেমটা ফলপ্রসূ হচ্ছে কি না! আমি একবার যুগান্তরে একটি কলামে লিখেছিলাম- যদি এমন করা যেত যে শহরের কিংবা ভাল স্কুলের ভাল বেতনের ভাল শিক্ষকরাও অন্তত বছরে ১ মাস গ্রামের কোন স্কুলে গিয়ে শিক্ষাদান করবেন, তাহলে গ্রামাঞ্চলের ছেলে-মেয়েরাও ভাল শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেত। এজন্যই যেকোন ভর্তি পরীক্ষায় গ্রাম এলাকার একটি ছাত্রের জন্য অল্প সংখ্যক কিছু কোটা পদ্ধতি রাখার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মত আছে। কেননা সে তো শহরের একটি ছাত্রের তুলনায় অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে আপনার মত?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি খুবই কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু সেটার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। সাথে সৃজনশীল পদ্ধতিতে উত্তর দিতে ছেলেমেয়েদের কেও কিন্তু সেভাবে শেখাতে হবে। আমার তো মনে হয়- এখনো যথাযথ সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র করা হয়না, কেননা আমার ব্যক্তিগত ধারনা, যদি তা করা হত, তবে ফলাফল কিন্তু আগের তুলনায় খারাপ হত। কিন্তু আমাদের এস এস সি, এইচ এস সি-র ফলাফল তো ভাল থেকে ভালতর হচ্ছে। আমার আশা - এ পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে শিক্ষার প্রকৃত মান ভাল করা যাবে। তবে, এর জন্য ভাল বেতন দিয়ে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ করাটা পূর্বশর্ত।
পরীক্ষা প্রসঙ্গ চলে আসলো! আইনস্টাইন নিজেই যেমন পরীক্ষা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বলতেন কেউ যদি তার লেকচার নিয়মিত শোনে এবং লেকচার শেষে তার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে তাহলে তিনি এমনিই তাকে পূর্ণ নম্বর দিয়ে দিবে। অনেক ভাল শিক্ষার্থীরও আবার পরীক্ষা ভীতি কাজ করে। এবং এই পরীক্ষার ফলাফল থেকেই ছাত্রের মান যাচাই করা হচ্ছে। আপনার এ নিয়ে বক্তব্য কি?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : ফলাফল কখনও একজন ছাত্রের মান যাচাইয়ের একমাত্র মানদন্ড হতে পারে না। পরীক্ষা এবং পরীক্ষার ফলাফল আসলে যে কোর্সটি সেই ছাত্র করল তার উপরে তার দক্ষতা যাচাইয়ে সম্ভাব্য ধারণা দেয়। ছাত্রটি উক্ত বিষয় সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞাত, তা বুঝতেই এই পরীক্ষা পদ্ধতি। তবে অনেক ছাত্র ভাল ফল করলেও সে ঐ বিষয় সম্পর্কে ভাল রকমে দক্ষ তা কিন্তু বলা যায় না, মুখস্ত করেও ভাল ফল করা যায়। আবার অনেক ছাত্রের ফল ভাল না হলেও সে উক্ত বিষয়ে ভাল রকমের দক্ষ হতেই পারে। তাই শুধু এই ফলাফল দেখেই কিন্তু চাকরি হয় না। চাকরি কিংবা ভর্তি প্রক্রিয়ায় শুরুতে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যের ছাত্রদেরকে ডাকা হয় এই আশায় যে প্রতিষ্ঠানটি যে ধরনের ছাত্র আশা করছে তা এই সীমার মধ্যেই আছে। কিন্তু চাকরি পাওয়া নির্ভর করবে তার কারিগরী জ্ঞানের উপর। আমাদের এরকমও ছাত্র আছে যারা বিশ্বের সর্বোত্তকৃষ্ট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগলে গিয়েছে, কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ততটা ভাল নয় এবং এক বিষয়ে ফেল ও করেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। গুগল তাকে চাকরি দিয়েছে নির্দিষ্ট বিষয়টাতে সে কতটুকু দক্ষ তা যাচাই করে। আর সীমা নির্ধারণেরও যুক্তি আছে। তা হলো- ফলাফল অন্তত মোটামুটি হওয়া জরুরী। নাহলে প্রতিষ্ঠানটি তোমার ফলাফল দেখে এটাই ভাববে যে- ছেলেটি যতই মেধাবী হোক না কেন, সে কখনও তার কোর্সে গুরুত্ব দেয়নি। আর যে ছেলে ঠাট্টাচ্ছলে তার কোর্স পার করে, সে নিশ্চয়ই তার কাজের প্রতিও অবহেলা করবে, তাই তখন কোন প্রতিষ্ঠানই তাকে নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে না।
পরবর্তী প্রশ্ন ছিল পরীক্ষা ভীতি নিয়ে। বর্তমানে এতগুলা পরীক্ষা দিয়ে এসে মনে হয় পরীক্ষা ভীতি আর থাকার কথা না।
আর বাস্তবতা বিবেচনায় আইনস্টাইনের বক্তব্যের সাথে আমি একমত না। শুধু নিয়মিত ক্লাশ করলে আর লেকচার শেষে কতিপয় শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করে সদুত্তর পেলেই সবাইকে পূর্ণ নম্বর দেয়া যায় না। সমগ্র কোর্সের উপরে তার দক্ষতা যাচাই প্রয়োজন। পরীক্ষা হলো সেই মান যাচাইয়ের পদ্ধতি। তবে হ্যা, ফলাফল খারাপ করলেই তার মেধা নেই বলা যায় না। আমাদের সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত তাদের সবাই কি এসএসসি তে ফার্স্ট ডিভিশন ফার্স্ট ছিলেন! তা তো না, কিন্তু তারা তাদের মেধা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে ঠিকই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই পরীক্ষার পদ্ধতি ঠিক আছে বলেই আমার মনে হয়। তবে পরীক্ষার সংখ্যা এবং প্রশ্নের মান পরিবর্তন হওয়া দরকার।
আমাদের ছোট বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে গড়ে তোলার চর্চা খুবই কম। এদিকে চর্চা কম হচ্ছে কেন, বাঁধা কোথায়?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : আমি যেটা আগেও বললাম যে আসলে আমরা এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ করতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিন্তু সবচাইতে ভাল ফলাফলকারী মেধাবী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক পদে নিয়োগ পায়, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে সুযোগ নেই। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে শুধু বিজ্ঞানমনস্ক কেন গণিত, চিত্রকলা এমনকি খেলাধূলার চর্চাও করানো যেত। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এমন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া দরকার যিনি মেধাবী এবং শিক্ষার্থীদেরকে এসব বিষয়ে চর্চা করাতে আগ্রহী। সেজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনও অনেক বাড়াতে হবে।
আমাদের যে গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড এর মত প্রতিযোগিতাগুলো আয়োজন করা হয়, সেখানে শুধু প্রতিযোগিতাই হয় কিন্তু তাদেরকে শেখানোর কাজটা কিন্তু বাকী থেকেই যায়। এই আশা করা হয় যে, প্রতিযোগিতায় আসতে গেলে এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশে আসলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শিখে নিবে। কিন্তু যারা ভাল করছে তারা আসলে আগে থেকেই ভাল, তারা আসলে এমনিই মেধাবী। যারা একটু কম মেধাবী তারা পরিচর্যার মাধ্যমে ভাল জায়গায় গিয়েছে এমন সংখ্যা খুবই কম। তা তো ঠিক না। তাদেরকে আগ্রহী করতে হবে, তাদের চিন্তা-চেতনায় সাহায্য করতে হবে, শেখাতে হবে। আর মেধার মুল্যায়ন যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে কিন্তু মেধার বিকাশও হবে না। কারণ যারা মেধাবী কিন্তু একটু পরিচর্যা আর মুল্যায়নের অভাবে এগোতে পারছে না, তারা একটা সময়ে হতাশ হয়ে যাবে। আর এক্ষেত্রে কাজ করতে হবে সরকারকেই। যেগুলো প্রসঙ্গ উঠে আসলো আজ সবগুলোতেই সরকারকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষা খাত অবৈতনিক করা দরকার কি?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : সবার সামর্থ্য যেহেতু এক না আর পরিচর্যার অভাবে যেহেতু অনেক মেধা ঝরে যায়, তাই অবৈতনিক করা গেলে খুবই ভাল। তাছাড়া শিক্ষা তো নাগরিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আমি যদি শিক্ষা খাতে ব্যয় করে আমার জাতিকে শিক্ষিত করে তুলি সেটা তো আমাদের জন্যেই ভাল। শিক্ষিত হয়ে গেলে প্রতিটি পরিবার নিজেরাই স্বচ্ছল হয়ে যাবে, দারিদ্রতা দূর হয়ে যাবে, অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে। অবৈতনিক করা গেলে শিক্ষার্থীদের উপরও মানসিক দায়িত্ব পড়ে যায় যে যে জনগনের টাকায় আমি শিক্ষিত হলাম তাদের জন্য আমার কাজ করতে হবে। তবে, এক্ষেত্রে শুধু গ্রাম/মফস্বল এলাকার বিদ্যালয়গুলো অবৈতনিক করলে অনেক ভুয়া রেজিস্ট্রেশন এর শিক্ষার্থী পাওয়া যেতে পারে। তাই অবৈতনিক করতে গেলে সকল জায়গার বিদ্যালয়গুলোকে একসাথে অবৈতনিক করাই উচিত। অবৈতনিক করা না গেলেও অন্তত বাইরের দেশের মত ঋন নিয়ে শিক্ষা নেয়ার পদ্ধতি চালু করা যায়, শিক্ষাজীবন শেষে চাকুরি করে সেই ঋন শিক্ষার্থী পরিশোধ করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পড়াশুনাও বাধাগ্রস্ত হবে না, আবার সাথে এটাও সে বুঝতে পারবে যে, দেশের মানুষের টাকায় পড়াশুনা করেছে, সুতরাং সেটা আবার দেশকেই ফেরত দিতে হবে। সরকার একজন শিক্ষার্থীর জন্য কত টাকা খরচ করছে, এটা আমাদের সকলেরই অনুধাবন করতে হবে।
এবার আপনার বিভাগে ফিরে আসি। প্রোগ্রামিং এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার উপায় কি?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : প্রোগ্রামিং নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে, আমিও অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমার মনে হয় প্রোগ্রামিং অনেক সময় নিয়ে শেখানোর বিষয়। এটা অন্য ৮-১০টা বিষয়ের মত স্বল্প সময়ের কোর্স না যে আমি লেকচার দিলাম, তোমরা মন দিয়ে শুনলে, পরীক্ষা দিলে আর পেরে গেলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্য বিষয়গুলোর মত প্রোগ্রামিং এর জন্যও লেকচারের সময় বরাদ্দ একই থাকে। শিক্ষার্থীদের মেধা কম তা আমি বলব না, তবে সব শিক্ষার্থীর দ্রুত গ্রহণ করার ক্ষমতা তো আর একরকম না, সবাই প্রোগ্রামিং এত স্বল্প সময়ে ধরতে পারে না। ছাত্রদের প্রোগ্রামিং এ ভাল করতে গেলে ক্লাশে যেমন মনযোগী হতে হবে, পরেও ২-৩ গুণ বেশি সময় দিতে হবে, বাসায় প্রোগ্রামিং এর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পিছনে প্রচুর সময় দিতে হবে। এক্ষেত্রে একেকজন শিক্ষার্থীকে একেকরকম সময় দিতে হবে। তবে নিয়মিত যদি ২-৩ ঘন্টা প্রোগ্রামিং করা হয়, তাহলে যেকোন ছাত্রই এটা আয়ত্ব করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। ‘প্রতি সপ্তাগে আমি অন্তত ১০টা নতুন প্রোগ্রামিং সমাধান নিজে করব’ – এরকম একটি পরিকল্পনা করে আগানো যেতে পারে। আর, একবার যদি একটা প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ এ পরিষ্কার ধারণা চলে আসে, তাহলে তাকে আর পিছিয়ে থাকতে হবে না, তার জন্য অন্যান্য ল্যাংগুয়েজ শিখতেও বেশি সময় লাগবে না।
কম্পিটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের আপনার শিক্ষার্থীদের দেশে ভবিষ্যত কেমন?
• সুকর্ণ বড়ুয়া : নিঃসন্দেহে খুবই ভাল। পুরো দেশই এখন আইসিটি’র দিকে যাচ্ছে। সরকার আইসিটি তে বরাদ্দ প্রচুর দিচ্ছে, সামনে আরও বাড়বে। আইসিটি পার্ক তৈরী হলে দেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানসমূহের শাখা যুক্ত হবে, তখন এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাজের পরিসর বাড়বে। এমনকি অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আইসিটি’র উপরে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আসলে কর্মসংস্থানের জায়গা এখনও অনেক পরে আছে, কিন্তু যোগ্য লোকের অভাব রয়ে গেছে। আমি আশা করি এ জায়গাগুলোই আমার শিক্ষার্থীরা যোগ্য জায়গা করে নিবে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ রুদ্র কাওসার, বিশেষ প্রতিবেদক , ডেইলি দর্পণ
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন