রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার হরিঙ্গচর গ্রামের জৌতিকা চাকমা সম্প্রতি প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে। সন্তান প্রসবের জন্য অস্ত্রোপচার করতে হবে তাঁকে। এ জন্য প্রয়োজন এ পজেটিভ রক্ত। জৌতিকার অভিভাবকেরা রক্তের সন্ধান করতে লাগলেন। হাসপাতালের আসা এক ব্যক্তির কাছ থেকে পেলেন অরণ্যে তারুণ্য নামের একটি স্বেচ্চাসেবী সংগঠনের সদস্য অপু দত্তের মুঠোফোন নম্বর। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই রক্তের ব্যবস্থা হলো।
কেবল জৌতিকা নন, ছালেহা বেগম, চিত্তরানি চাকমা, অংথোয়াই মারমাসহ অন্তত ৫০০ রোগীকে গত কয়েক বছরে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে অরণ্যে তারুণ্যের সদস্যরা। খাগড়াছড়ি শহরের একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবী গঠন করেছেন এই সংগঠন। সংগঠনের প্রায় ৩০০ তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা যে কারও প্রয়োজনে হাজির হন হাসপাতালে। এভাবে বিনা মূল্যে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক অনেক কাজ করছেন এই সংগঠনের সদস্যরা।
কী করে হলো তরুণদের এই মহতী উদ্যোগ? অরণ্যে তারুণ্যের সদস্যরা জানালেন, সংগঠনের সংগঠকেরা সবাই প্রায় সমবয়সী ও বন্ধু। আড্ডা, অ্যাডভেঞ্চার দুটোই সমান প্রিয় তাঁদের। সাইকেল নিয়ে ঘুরতেও বেরোতেন দলবেঁধে। কিন্তু এমন একটা ভ্রমণের আয়োজন কী করা যায়, যা মানুষের উপকারেও আসবে—এমন ভাবনা থেকেই ২০০৭ সালের ৫ জুন অপু দত্ত, রফিকুল ইসলাম, হেদায়েত উল্লাহসহ ১১ জন তরুণ বেরিয়ে পড়েন সাইকেল নিয়ে। মাদক, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, শিশুশ্রম, দুর্নীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্লোগান ঝুলিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যান তাঁরা। এ সফরে লোকজনের ব্যাপক সাড়া পান। ওই বছরের ৩ জুন গঠন করেন অরণ্যে তারুণ্য নামের একটি সামাজিক সংগঠন।
সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরপরই খাগড়াছড়ির তৎকালীণ জেলা প্রশাসক শাহাদাৎ হোসেনের উৎসাহে লেগে পড়েন জেলার আটটি উপজেলার মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরিতে। পাশাপাশি শুরু করেন শিশুশ্রমের ওপর জরিপ। বর্তমানে অরণ্যে তারুণ্যের বয়স সাত বছর। এরই মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, রক্তদান, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ ও সচেতনতামূলক সামাজিক কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। জেলার অনেক রোগী এখন রক্তের জন্য নির্ভর করেন অরণ্যে তারুণ্যের ওপর।
জনহিতকর কাজের পাশাপাশি তরুণদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছে এই সংগঠন। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পেশাজীবী তরুণদের নিয়ে আয়োজন করা হয় সামাজিক দক্ষতা ও উন্নয়নবিষয়ক কর্মশালা। এসব কাজের পাশাপাশি পরিবেশের বিষয়েও তাঁরা সোচ্চার। চেঙ্গী নদীর ভাঙন রোধে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন তাঁরা।
কেবল খাগড়াছড়িতে নয়, আশপাশের উপজেলাগুলোতেও সেবার হাত বাড়িয়েছে অরণ্যে তারুণ্য। দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা পলাশ নাগ বলেন, ‘আমি জেলায় কর্মরত থাকাকালে কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যে তারুণ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতাম। যোগাযোগের কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত মিলত।’
অরণ্যে তারুণ্যের সহসভাপতি অপু দত্ত বলেন, ‘২০০৭ সালে অরণ্যে তারুণ্য গঠনের সময় ভাবিনি আমরা এত দূর আসতে পারব। মানুষ আমাদের এত কাছে টেনে নেবে। এখন নিজেদেরই কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারও রক্তের চাহিদার কথা শুনলে আমরা স্থির থাকতে পারি না। কারণ, মানুষের জীবন বাঁচানোর মধ্যে একটা গভীর আনন্দ আছে। আসলে মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেড়ে গেছে।’
সূত্র- প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন