কোন একটি কাজ বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য বা বাস্তবায়ন করার জন্য যিনি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তাঁকেই উদ্যোক্তা বলে। অর্থাৎ উদ্যোক্তা মানে হচ্ছে সংগঠক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান একটি উন্নয়নশীলমুখী দেশের প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য এবং তাঁর দূরদর্শিতার পরিচায়কও বটে। বাংলাদেশে শ্রম অনেক সস্তা হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে কাঙ্খিত বিনিয়োগ আসেনি বাধাগুলো দূর না হওয়ায়। নীতি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। তাই বাংলাদেশ এখনও উদ্যোক্তাদের জন্য পথ অত্যন্ত বন্ধুর। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানারকম প্রশাসনিক জটিলতা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিও উদ্যোক্তা নয়। দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশ উদ্যোগই কৃষিভিত্তিক। অর্থাৎ জমির মালিক না হলে ব্যবসা শুরু করা মুশকিল। আর অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ পারিবারিক সূত্রে নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাদের পড়াশোনাই চলে একমাত্র সম্বল সামান্য জমির উপর নির্ভর করে বা জমি বিক্রির টাকায়।
অধিকাংশ ব্যাংক লোন দেয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে, হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা, জামানত হিসেবে জায়গার দলিল প্রদান করা, নয়তো গ্যারান্টার থাকা। কিন্তু তরুণদের একটা বড় অংশ নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের যাদের ব্যবসা শুরু করার পুঁজি বা সম্পত্তি কোনটাই নেই। নারীদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়া আরো দুরূহ, থাকে নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। একজন পুরুষের সমান যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও বাংলাদেশে শুধু নারী বলে ভিন্ন আচরণের সম্মুখীন হতে হয় একজন নারী উদ্যোক্তাকে। নারীরা উদ্যোক্তা হতে চাইলে অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অনেক সময় তাদেরকে পরিবারের দিক থেকেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নানা রকম সুবিধা বা সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময়ই বৈষম্যের শিকার হন নারী উদ্যোক্তারা। তবে বর্তমানে হাতে গোনা ২/১ জন প্রতিষ্ঠিত বা অভিজ্ঞ নারী উদ্যোক্তারা নতুন নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করবেন এই বিশ্বাসে আগের চেয়ে নবাগতরা উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস পাচ্ছেন। কিন্তু এই এতেও সফলকাম হচ্ছেন না। ফলে ঝরে পরে রীতিমত হতাশায় ভুগছেন। বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ কণ্টকাকীর্ণ, অনুকূলে নয়। প্রতিষ্ঠিত বা পরীক্ষিত পথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করলেই উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। একজন উদ্যোক্তা তার রাস্তা নিজে তৈরি করেন। এখানে ঝুঁকির সম্ভাবনা শতভাগ। তাই যারা এ পথে হাঁটার সাহস করেন তাদেরকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতে হবে। নিতে হবে কার্যকরি সব উদ্যোগ। কিন্তু বিষয়টা রীতিমত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বাস্তবতা বিবেচনায় বলা যায়, বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্ম বাধ্য হয়েই চাকরির উপর নির্ভরশীল। উল্লেখ্য যে, চাকরিতে প্রবেশের বাধা থাকায় যাদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ রয়েছে তারাও সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে ২৪/২৫ বছর থেকে পরবর্তী চার/পাঁচ বছর চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করায় মন দেয়। অথচ উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। এদেশে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সের সীমারেখা থাকায় ত্রিশের পরে উচ্চ শিক্ষিতদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। এছাড়া দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হবার পর অথবা যে কোন উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পর অনেকে দেশের সেবায় অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে চান। কিন্তু বয়সের এই সীমাবদ্ধতার জন্য তা সম্ভব হয়ে উঠে না। অভিজ্ঞতা বলছে, যে স্বল্প পুঁজি নিয়ে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষিত তরুণরা ভাল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে এর মধ্যে শতকরা পাঁচজনই সফল হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব, পারিবারিক সমস্যা ও আর্থিক অবস্থা এবং ঝুঁকি। যেমন- কেউ একজন মাছের চাষ বা গরুর খামার করলো। কিন্তু কোন কারণে মাছ বা ঐ গরুগুলো মরে গেলো। তখন বিফলে যাওয়া হতাশাগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্তদের পাশে কি কেউ দাঁড়ায়? সভা, সমাবেশ ও সেমিনারে আমরা এক শ্রেণি বলতে পারি উদ্যোক্তা হও, দেশ গড়। কিন্তু এর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক আমরা কয়জন? উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উপরোক্ত বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান করে এর জন্য একটা অনুকূল ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে কোন যুগোপযোগী নীতিমালা। তবে বিষয়টা খুব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় দেশের বর্তমান অপার সম্ভাবনাময় সোনালি ও শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে চাকরি ক্ষেত্রে কাজে লাগানোই উচিত। এতে করে অন্তত বর্তমান প্রজন্মটা কর্মে প্রবেশের মাধ্যমে দেশকে বেকারত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারবে। আর এই জনশক্তিকর অপচয় রোধকল্পে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগটা দ্রুতই উন্মুক্ত করে দেওয়ায় যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছি।
লেখক : প্রকৌশলী-প্রাবন্ধিক
nazmulhussen@yahoo.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন