ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা সহ পৃথিবীর নানাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মেধাবী বাংলাদেশী, অবদান রাখছে সে সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। শিক্ষা, জনসাস্থ্য, প্রকৌশল, জ্বলানি সহ বিবিধ খাতে তাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তাদেরই একটি বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে দক্ষ পেশাদার ক্যাটাগরিতে, কেউ বা উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা, আবার কেউ বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার উদ্দেশ্যে প্রবাসী হচ্ছেন। এদের সবাই নিজ নিজ পেশা ও মেধার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হলেও তাদের দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়িত্ববোধ নিয়ে সমাজে নানা রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, সরকারি/বেসরকারি মেধাবী আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষক, গবেষক, ছাত্র উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমন করে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে দেশে না ফিরে স্থায়ীভাবে প্রবাসী হচ্ছেন, সে সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাদুকরী ভুমিকা রাখলেও নিজ দেশে ফিরে আসছেন না। এ সমস্ত মেধাবী প্রবাসী বাংলাদেশি, নিজ দেশের উন্নয়নে ভুমিকা না রেখে কেনই বা তাঁরা চাপরাশি, ড্রাইভার, পাইক- পেয়াদা, অবারিত ক্ষমতা আর বিলাসের মোহ ত্যাগ করে, প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামের কঠিন পথটিকে ই বেচে নিলেন? এর দায় কি শুধুমাত্র প্রবাসে বসতগড়া ব্যক্তিটির নাকি সমাজ তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসীনতা ও এর জন্য দায়ী!!
উপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত কুলীন আমলাতন্ত্রের অযুগপযোগী রীতিনীতি ও কৌশলের ধারাবাহিকতায় পশুসম্পদ ও পশু গবেষণা নিয়ে পিএইচডি করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে, উন্নয়ন অর্থনীতির পিএইচডি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার রেল বিভাগে এমনতর ঘটনা কি শিক্ষা আর গবেষনায় শীর্ষস্থানে থাকা মেধাবী কে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যুগাতে পারে? সরকারি চাকুরিতে সিনিয়রিটির বাধ্যবাধকতা, অনৈতিক পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া, সরকারি দলের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা, লেজুড়বৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, ব্যক্তি লেহন ইত্যকার বিষয়গুলো যখন পদোন্নতির ক্ষেত্রে জড়িয়ে যায়, তখন বিদেশ বিভুইয়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের বিপরীত চিত্র যদি কাউকে আকৃষ্ট করে, কোন বিবেচনায় সেটি অন্যায় হতে পারে?
সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি চিকিৎসা, শিক্ষা সহ সকল মৌলিক মানবাধিকার ও বিভিন্ন পরিষেবার প্রশ্নে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমানাধিকার বিদ্যমান- এমন পরিবেশে বসবাসের ইচ্ছা কি প্রত্যাশিত নয়? ভিআইপি, ভিভিআইপি, যারা অর্থ বিত্তে ক্ষমতা শালী তারাই যখন প্রাধিকার, এমন সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার অনাগ্রহ কি অমার্জিত কোন অন্যায়? কায়ক্লেশে জীবন যাপনকারী শিক্ষক পিতাকে ইনক্রিমেন্ট, আর মহার্ঘভাতা সংযোজনে সারাজীবন ১০% অগ্রিম উৎকোচ গুনতে হয়, বৃদ্ধ পিতাকে তার পেনশনের টাকা পেতে জরাজীর্ণ শরীর নিয়েও বছরের পর বছর ঘুরে বেড়াতে হয়, এমন সমাজে ফিরে না যাওয়া কি শুধুই দেশপ্রেমের অভাব! প্রাজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ স্যারকে সম্মান রেখে বলতে চাই, তিনি যখন ইউরোপ, আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের দেশপ্রেম নিয়ে, তরুণ সমাজের সামনে কটাক্ষ করেন, তার পূর্বে কি তিনি সংশ্লিষ্টদের হ্রদয়ের দহনটি পাঠ করতে পেরেছিলেন?
সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা, লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রিয় বাংলাদেশ এর অভ্যুদয়ে প্রাণশক্তি ছিল ক্ষুদা, দারিদ্র, শোষনমুক্ত, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। ৭৫ এর বিয়োগান্তক ঘটনা পরবর্তী দুদশকের উল্টো পথের যাত্রায় দেশপ্রেমের মূল্যবোধহীন একটি যান্ত্রিক প্রজন্মের জন্ম হয়েছে তাতে খুব বেশি অমত করার সুযোগ নেই, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বিত্তের বাসনায় মত্ত আদর্শিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক বিশাল লোভাতুর শ্রেণী। সময়ের বিবর্তনে এদের অব্যাহত আস্ফালন আজও থেমে নেই, আর এর ই নেতিবাচক প্রভাবে প্রলম্বিত হচ্ছে দূর্নীতিমুক্ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা সংবলিত একটি সার্বজনীন সমাজ ব্যবস্থার অব্যাহত আকুল আকুতি। এমন আকুতি আর আর্তচিৎকারে সারাদিয়ে কাংখিত সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাওয়া ই হতে পারে, মেধাবী প্রজন্ম কে দেশে ফিরিয়ে আনার মোক্ষম হাতিয়ার।
আমার বসবাস কল্যাণ রাষ্ট্র কানাডার অর্থনীতির ভিত্তি দেশটির প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ তথা তেল ও গ্যাস। প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে পৃথিবীর পঞ্চম এবং তৈল সম্পদে ষষ্ঠ বৃহত্তম দেশ, অভ্যন্তরীণ জিডিপি তে ২০১৮ সালে যার অবদান ১০৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৮ এই তিন বছরে শুধুমাত্র এই সেক্টরে নিয়োজিত ৫,৩০,০০০ কর্মিদের উপার্জিত আয় থেকে সরকার গড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আদায় করেছে। কানাডিয়ান এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে শুধুমাত্র Alberta Oil Sands থেকে গত দশ বছরে প্রাদেশিক ও ফেডারেল সরকারে প্রদেয় রাজস্বের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলারের ও বেশি। আনন্দের সাথেই জানাতে চাই আলবার্টা তথা কানাডার অর্থনীতির প্রাণ এই তেল-গ্যাস সেক্টর বাংলাদেশী ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ আর প্রকৌশলীদের অবদানে সমৃদ্ধ ও গৌরবান্বিত। প্রিয় বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা কে আরও প্রসারিত করেছে, সেই সাথে কানাডার মতো দেশে বসবাসকারী হাজার হাজার ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ পেশাদার প্রকৌশলীদের মেধা কেন নিজ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারছে না তা ভেবে দেখার সময় কি এখনো আসেনি? বিপরীতে অন্তরায়গুলো খুজে বের করা জরুরী নয় কি? শুধুমাত্র দেশপ্রেমের অভাব - একথা বলেই কি দায় এড়ানো সম্ভব?
আলোকিত সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়নে শিক্ষা কাঠামোর আমূল সংস্কার সময়ের দাবী। জাতীয়তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, দৃঢ় নৈতিক মুল্যবোধ সম্পন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ার নিমিত্তে শিক্ষা সেক্টরে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনী পদক্ষেপ সমূহ কে আর ও অনেক বেশী গতিশীল করার কোন বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল পদ-পদবী কে মুখে সম্মানজনক না বলে প্রকৃত অর্থে আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক পর্যায়ে উপনীত করতে হবে। যে দেশে শিক্ষকদের সম্মানের প্রশ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা পাঁচ বছরে ও বাস্তবায়ন হয় না, অধিকার আদায়ে উচ্চ আদালতের দারস্থ হতে, আদালতের সিদ্ধান্ত পেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে যায়, এমন বিসদৃশ পরিস্তিতি মেধাবীদের আকর্ষনে সাংঘর্ষিক নয় কি?
বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য আজ বিশ্ব অর্থনীতির সকল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সহ সকলের কাছেই সর্বজন বিদিত। একযুগের গড়ে ৭% বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি, ৩৬০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্থনৈতিক সক্ষমতার ই প্রমান, যদিও বা এর সুফল বা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সপ্ন সারথি খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান এর মতো বিজ্ঞজনরা ও অাজ অতৃপ্ত। তাই আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন, দূর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা, তবেই প্রবাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধন্য হয়ে নিজ দেশের উন্নয়নে দক্ষতা আর পেশাদারিত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে ভবিষ্যত প্রজন্ম - তরান্বিত হতে পারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর লালিত বাসনা - সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা।
লেখক. উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন