এ লেখা যখন লিখছি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণ। এমন বিরল লগ্নে এ স্মৃতিচারণমূলক লেখার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত, গর্বিত।
বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয় বাস্তবায়নের শুভসূচনা ঘটেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' - বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসেরই সমার্থক নাম। প্রগতিশীল চেতনা, গণমানুষের মুক্তি ও আধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্ন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় লালন করেছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন-প্রত্যাশা ও আগামীর পথে অগ্রযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ও শিক্ষায়তনিক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কালজয়ী কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্য "বনলতা সেন"-এর ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতার শিরোনামটি এ স্মৃতিকথার শিরোনাম হিসেবে মানানসই হতে পারে। কারণ ঠিক কুড়ি বছর পেরিয়ে গেল আজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার শিক্ষায়তনিক সম্পর্কের বিবেচনায়। এ ব্যাপারে কিছু কথা বলার আছে। তার আগে অন্য কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা প্রয়োজন।
আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগসূত্রটি মূলত পরিবারকেন্দ্রিক। আমার আম্মা, বড় বোন, ছোট ভাই, মামা, খালা, খালু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালনকালে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি আমারই সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কারুশিল্প বিভাগের বর্তমান সভাপতি ফারহানা ফেরদৌসীকে।
ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার যে নিবিড় সংযোগ গড়ে উঠেছে, তা নিছক বিদ্যায়তনিক নয়| বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই আমি অন্তর থেকে এ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গনকে সবসময় অনুভব করেছি। এর বীজটি বুনে দেয়া হয়েছিল আমার পরিবারে। আমি ওপরে যাদের কথা বলেছি, তাদের মধ্যে আমার আম্মা হাবিবা-হা-নূর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনিই ছোটবেলা থেকে আমাকে ও আমার ভাই-বোনদের বলতেন, "তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। ভালোভাবে পড়ালেখা করলে সেখানে পড়ালেখা করার সুযোগ পাবে। তোমার মামা, তোমার খালা ওখানে পড়ালেখা করেছে। সবাই তাদের কথা শুনলে কত খুশি হয়!" আম্মার সেই কথাগুলো এখনো মনে পড়ে!
স্কুল ও কলেজে ছাত্র হিসেবে পরীক্ষাগুলোতে মোটামুটি ভালো ফলই করতাম। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটিকে অসম্ভব বা এখানে ভর্তি হবার সুযোগ পাব না - এমনটি কখনো মনে হয়নি। এর আরেকটি কারণ হলো, বড় বোন এখানকারই ছাত্রী ছিল। সে উচ্চ মাধ্যমিকে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল। কীভাবে পড়ালেখা করলে এখানে ভর্তি হওয়া যাবে, সেটাই ছিল ভাবনায়। ফলে এ নিয়ে আমাকে কখনো উদ্বেগ বা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি।
মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও উচ্চ-মাধ্যমিকে বাণিজ্যের ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ভর্তির জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ভর্তি পরীক্ষাও ভালো হয়েছিল। ফলে ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষে তদানীন্তন বিবিএ (সম্মান) প্রোগ্রামের অন্তর্গত ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম।
কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক পড়ালেখায় আমার মতি হয়নি। উচ্চ-মাধ্যমিকে যে দুই বছর ঐ বিষয়ে পড়েছিলাম, তা শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য। কুইনাইনকে মানুষ তো শখ করে গেলে না! ঠেলায় পড়লে তবেই গেলে। আমিও উচ্চ-মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ব না আর মানবিক বিষয়ে পড়ার সুযোগ আম্মা-আব্বার জেদের জন্য পাইনি বলে বাণিজ্য বিষয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আমি আবার গোয়ার্তুমি করেছিলাম, ব্যবস্থাপনায় পড়া বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে। সেই বছরই আমি ঘ ইউনিটেও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং বাণিজ্য অনুষদ থেকে ৬৮তম
মেধাস্থানে ছিলাম। ফলে আমি চাইলেই সমাজবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা অর্থনীতি প্রভৃতির যে কোনো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেতাম। কিন্তু আমি নির্দিষ্ট দিনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েও ফিরে এসেছিলাম একারণে যে, তখন আমি সবে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছি আর এ বিষয়ে মনোনিবেশের চেষ্টা করছিলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী একজন শিক্ষক যখন সেখানে অপেক্ষমা্ন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলেন, এখানে উপস্থিত কেউ ইতোমধ্যে অন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে কি না, আমি আমার ব্যাপারটি বলি। ফলে তিনি আর আমাকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ দেননি। কারণ আমি দুটো বিষয়ে ভর্তি হতে পারব না, অহেতুক আসন নষ্ট হবে বলে! সেই বছর অন্য বিষয়ে ভর্তির সুযোগও ছিল না। এ নিয়ে পরিবারে যথেষ্ট অশান্তি হয়। তখন বিবিএ অনার্স ছিল অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়। সবে চার-পাঁচ বছর হলো, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে। চাকরির বাজারে খুব ভালো সুযোগ থাকায় ছেলেমেয়েরা এর পেছনে ছুটছে, ব্যাপারটি এমনই ছিল।
ফলে আমার এমন আচরণে পরিবার খুব আহত হয়েছিল। আমাকে বারবার বলা হয় পরের বছর পুনঃভর্তির জন্য। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। বরং পরের বছর আবার ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হই এবং বাংলা বিভাগে ভর্তি হই।
১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে ২০০০ সালের জুলাই থেকে আমাদের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। মনে পড়ছে, শ্রেণিকক্ষে আমার রোল ছিল ১১০। আমি সলিমুল্লাহ হলের অনাবাসিক ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা সম্পন্ন করি। প্রথম ক্লাসটি ছিল অধ্যাপক ড. সিদ্দিকা মাহমুদার। ২০১৭ নং রুমে সকাল ৯টায় সোমবারে তিনি রূপতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, ছন্দ ও অলংকার বিষয়ক কোর্সের ক্লাসটি নিয়েছিলেন। আপা চতুর্থ বর্ষে বাংলা কবিতার কোর্সটি পড়াতেন। এ কোর্সে সেবার আমি সবচেয়ে ভালো ফল করায় একাই তিনটি মেধাবৃত্তি অর্জন করেছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলীর অন্তর্গত কয়েকজন শিক্ষকের ক্লাস করতে পেরে প্রকৃতপক্ষেই আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁদের কাছ থেকে সাহিত্যপাঠের দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল আয়ত্ত করতে পারা পরীক্ষার জন্য জরুরি ছিল।
কিন্তু সেই শিক্ষা আসলে এখন আমার কাজে লাগছে যতটা না উচ্চ পর্যায়ের গবেষণায়, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সৃষ্টিশীল লেখা তথা গল্প ও উপন্যাস লেখায়। এক্ষেত্রে আমি সর্বাগ্রে সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড.আনিসুজ্জামান স্যারের স্মৃতি স্মরণ করব। তিনি এমএ শ্রেণিতে বাংলা গদ্যের কোর্সটিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী ও কাজী আবদুল ওদুদের প্রবন্ধসমূহ পড়াতেন। সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে গদ্যের শৈল্পিক ও যৌক্তিক গ্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গলোর পাশাপাশি উল্লেখিত গদ্যশিল্পীদের সৃষ্টিশীল মানসের পরিচয় তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর প্রয়াণকে স্মরণ করে স্মৃতিবাহী পাঁচটি প্রবন্ধ লিখেছি। ফলে এখানে আর এসব প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি করছি না। বলে রাখি, ব্যক্তিত্বশীল মানুষ ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষক হিসেবে তাঁকে আমি যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছি ছাত্র ও সহকর্মী হিসেবে, এর ছায়ারেখা অবলম্বনে লিখেছি আমার ষষ্ঠ উপন্যাস 'মানুষ রতন'। এটি স্যার ও ভাবীকে উৎসর্গ করতে পেরে আমি আনন্দিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল গল্প ও উপন্যাসের কোর্সে। অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক স্যারের কাছে এমএ শ্রেণিতে যে বাংলা ছোটগল্পের কোর্সটি নিজের ইচ্ছায় বাছাই করেছিলাম, তা শুধু একটিই কারণে। তিনি তৃতীয় বর্ষে বাংলাদেশের সাহিত্য - শিরোনামের কোর্সে বাংলাদেশের কথাশিল্পীদের গল্প ও উপন্যাস এত চমৎকারভাবে পড়িয়েছিলেন যে আমি তাঁর পাঠগ্রহণে সম্মোহিত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে তাঁর তত্ত্বাবধানে এমফিল করার যে পরিকল্পনা, এর বীজ সম্ভবত এ ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের টিউটোরিয়াল পরীক্ষার খাতায় স্যার এত যত্ন করে আমার লেখার ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন যে মনে হত, মা-বাবার পর শিক্ষককে যে সন্তানের অভিভাবকের মর্যাদা দেয়া হয়, এ গুণের জন্যই!
আমার গবেষণার হাতে-খড়ি তাঁর সাহচর্যেই হয়েছিল। কীভাবে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে হয়, তিনিই আমাকে তা শিখিয়েছেন। আমি আনন্দিত, স্যারের কাছে এমফিল করতে পেরে। তিনি ০২.০৭.২০২০ তারিখ বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র ও সহকর্মী হিসেবে আমার প্রত্যাশা, বিভাগের শিক্ষায়তনিক ও উচ্চতর গবেষণামূলক কার্যক্রম এবার প্রকৃতপক্ষেই এগিয়ে যাবে।
লোকসাহিত্যের কোর্সটি বিএ অনার্সের সবগুলো কোর্স থেকে আলাদা ছিল। অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ স্যার ছিলেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। দ্বিতীয় বর্ষে "মহুয়া" পালার পাশাপাশি "ঠাকুরমার ঝুলি" তিনি এমনভাবে পড়াতেন যে আমি যেন কিশোরবেলার দিনগুলোর স্বাদ ফিরে পেতাম তাঁর বক্তৃতায়। স্যারকে পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম, এ ব্যাপারে আগ্রহ তখন থেকেই জেগেছিল বলে।
চতুর্থ বা চূড়ান্ত বর্ষে বাংলা নাটক পড়াতেন অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ স্যার। রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরের "বিসর্জন" ও "রক্তকরবী" তিনি এমনভাবে পড়িয়েছেন যে খুব বেশি রেফারেন্স বইয়ের প্রয়োজন হয়নি। কথাসাহিত্য বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও দখল সম্পর্কে জানতাম বলেই ইউজিসির ফেলোশিপপ্রাপ্ত পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁর অধীনে গবেষণাকর্মটি চলমান রয়েছে।
অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্যারকে খুব মনে পড়ে। তিনি তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ বর্ষ ও এমএ শ্রেণিতে ভাষাবিজ্ঞানের কোর্স নিতেন। বিষয়টি কঠিন হলেও স্যারের পড়ানোর গুণে পরীক্ষায় ভালোই ফল করতাম। কিন্তু প্রচণ্ড আতঙ্কিত থাকতাম খটমট এ বিষয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে। মুখস্থবিদ্যা সহায় ছিল, এ বৈতরণী পার হতে।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারকে পেয়েছিলাম এমফিল করার সুবাদে। এতদিন যেভাবে বিভিন্ন কোর্সের পাঠগ্রহণ করেছি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে, এ ক্লাস তেমন ছিল না। স্যারের রুমে বসে যখন ক্লাস করছি, তার আগে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে আমাকে উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাসের শিক্ষকতা করতে হত। এমফিল গবেষক ও কলেজের প্রভাষক, পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দ্বৈত ভূমিকা একই দিন সকালে ও দুপুরে কখনো কখনো পালন করতে হয়েছে। স্যার নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করে প্রবন্ধ লিখে আনতে বলতেন।সেগুলো পরবর্তী ক্লাসে মূল্যায়নজনিত অভিমত জানাতেন। ফলে, গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার প্রস্তুতি হাতে-কলমে এভাবেই শিখছিলাম।
আমাকে যদি বলা হয়, কোনো শিক্ষকের ক্লাস করার সুযোগ আবার পেলে কার ক্লাস আবার করব, আমি এক বাক্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর স্যারের নামটি বলব। কারণ শুধু সাহিত্যবিষয়ক জ্ঞান ও ধারণা নয়, এর সঙ্গে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গের যোগসূত্র তিনি আমাদের এতভাবে ধরে ধরে বোঝাতেন যে তা ভোলার নয়। যারা স্যারের ক্লাস করেছেন বা স্যারকে জানেন, তারা অবশ্যই আমার এ কথার মানে বুঝবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ২০১০ সালে যোগদানের পর প্রথম একমাস সকালে ঘুম থেকে উঠলে প্রথমেই মনে হতো যে ব্যাপারটি, সেটি জেনে এখন হয়ত খানিকটা ছেলেমানুষি বলেই কারো কারো মনে হবে। কিন্তু এই সরলতা, ছেলেমানুষি, আবেগ আছে বলেই জীবন এখনো সুন্দর। ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমেই তখন আমার মনে হতো, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! কখনো কখনো নিজের গায়েই চিমটি কাটতাম আর হাসতাম। স্বপ্ন দেখছি না তো! সত্যিই তো ব্যথা পাচ্ছি! স্বপ্ন যখন বাস্তবতা হিসেবে গণ্য হয়, তখন এমনটি ঘটে!
দশ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা কী? এটুকুই বলব, সোনা যত অমূল্য হোক আর যতই চকচক করুক, নিখাঁদ সোনার কাজে লাগে না। তেমনিভাবে শুধু প্রশংসা আর ভালো ধারণাই যে এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতায় স্থান পেয়েছে, তা তো নয়। যদি তেমনটি ঘটত, তবে দুনিয়া থেকে যাবতীয় নেতিবাচকতা, খারাপ বিশেষণগুলো উঠে যেত। সেটি কখনোই সম্ভব নয় বলে যে যোগ্য, তাকে আরো বেশি যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। অন্যদের অনুসরণ না করে নিজের চলার পথ নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। কে কোন দিকে সফল হবে, সেটা সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে। কিন্তু জানাকে প্রমাণ করাটাই চ্যালেঞ্জ।
যে কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে, তাকে মুখ খুলতে হয় না। মুখ তাদের জন্য, যারা কাজ করে নিজেকে প্রমাণে অসমর্থ। ক্লাসে ছেলেমেয়েদের সাহিত্য পড়াই। পাশাপাশি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সাহিত্যে সংযোগ প্রসঙ্গে উদহারন দিই নিজের অর্জিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অবলম্বনে। তারাও প্রকৃত ব্যাপারগুলো জানুক, বুঝুক, সেখান থেকে যেটুকু আহরণের সামর্থ্য যার যেমন, ততটুকুই গ্রহণ করুক। কারণ জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শিখিয়েছে, যে নিজেকে সম্মান করতে জানে, সে অন্যকেও সম্মান করতে জানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। আমার এমফিল অভিসন্দর্ভ 'বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে প্রান্তজনের জীবনচিত্র' বই হিসেবে ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। অদ্যাবধি এটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রথম ও একমাত্র এমফিল অভিসন্দর্ভ, যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
আনন্দময় এ মাহেন্দ্রক্ষণে পরমশ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যারকে বারবার মনে পড়ছে। তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরজীবী হোক।
লেখক: তাশরিক-ই-হাবিব, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন