আত্মহত্যা!। জীবনের হাহাকার। অকালে ঝড়ে পরা বীন। একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু। একটি পরিবারের অপূরণীয় দীর্ঘশ্বাস। কতগুলো বিলম্বিত প্রশ্নের হতাশাজনক উত্তর। প্রতিটি আত্মহত্যাই একটি পরিবারের অসহনীয় চাপা কান্না। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী অথবা সেলিব্রিটি কেউ আত্মহত্যা করলে আমরা একটু বেশি সরব হই। কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক আত্মহত্যার ঘটনা হর হামেশাই ঘটছে বিভিন্ন মহলে। চলার পথে অনেক ঝড়-ঝাপটা, হতাশা থাকবেই। তাই বলে আত্মহত্যা নয়। কখনোই কাম্য নয় এটা। জীবনকে ভালোবেসে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। জীবন স্রষ্টার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মানুষের জীবন কোনো ছোট বিষয় নয়।
দিনের পরে যেমন রাত আসে তেমনি রাতের পরে আসে দিন। একইভাবে জীবনে ভালো সময় আসে। আবার খারাপ সময়ও আসে। রাত যত গভীর হয় ভোর তত কাছে আসে। কিন্তু আবেগের কাছে আমরা সবাই যেন হেরে যাই। কেন আমাদের এ হেরে যাওয়া? আমরা কি পারি না নিজেকে নিয়ে সত্যের মাধ্যমে ধৈর্যসহকারে সুন্দর পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে? অবশ্যই পারি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেন আত্মহত্যা প্রবণতা তৈরি হয়? এর প্রতিকার কী? আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব কী? গণমাধ্যমে কীভাবে আত্মহত্যার খবর প্রচার করা উচিত? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এবং আত্মহত্যা ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দপ্তর কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুৃঁজতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও এডুকেশনাল এবং কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক জানিয়েছেন বিস্তারিত-
আত্মহত্যার পেছনে কী কী কারণগুলো আপনারা চিহ্নিত করতে পেরেছেন? আত্মহত্যা কেন করে?
ড. মেহজাবীন হক: আত্নহত্যার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে কিছু ইন্টার্নাল কারণ ও কিছু এক্সটার্নাল কারণ থাকতে পারে। আবার আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কিছু থাকে তাৎক্ষণিক কারণ। আগে থেকেই তার ভিতর একটা ট্রমা আছে বলে জানা যায়। মানসিক রোগ, হতাশা একটা বড় কারণ আত্মহত্যার। হতাশা থেকে ব্যক্তি আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। বায়োলজিকালি আমাদের ব্রেণের মধ্যে এমন কিছু উপাদান পরিবর্তন হয়ে যায় সার্বক্ষণিক ঐ ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরতে থাকবে। তার চোখে ইতিবাচক কোনকিছু পড়ে না।
আর একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার কাছে কোন যুক্তি কাজ করে না। সে তখন হাইলি ইমোশনাল স্টেজে থাকে। তার আবেগের মাত্রা তীব্র থাকে। তার কষ্টটা এতই প্রকট হয় যে সে মরতে চায় না তবে ঐ কষ্ট টা থেকে মুক্তি পেতে চায়। তখন তার মনে হয় নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। ফলে মানুষ আত্মহত্যা করে। এক্সটার্নাল কারণের মধ্যে তার সারাজীবনের পারিবারিক বন্ধনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তার বঞ্চনাও একটা কারণ। অনেকের ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস থাকে কিন্তু সবাই আত্মহত্যা করে না। তার পার্সোনালিটি মেকআপ টা কেমন। সে কী পরিমাণ সাপোর্ট পাচ্ছে? এগুলো সবগুলোই কিন্তু জরুরী ব্যাপার।
ব্যক্তির আচরণে কি আত্মহত্যার লক্ষণ প্রকাশ পায়?
ড. মেহজাবীন হক: কখনোও যদি বন্ধুর মুখে শোনে যে কিছুই ভাল্লাগে না, মরে গেলে ভালো হয় এগুলো কে কথার কথা হিসেবে ধরবে না। এগুলো কিন্তু চিহ্ন। যে মরে যায় সে কিন্তু চুপ করে থাকে না। সে কখনো না কখনোই এই ধরণের ইঙ্গিত দিবেই। নিজের জিনিসপত্র দান করে দিচ্ছে, নিজের প্রিয় জিনিসটা দিয়ে দিচ্ছে এগুলো হলো চিহ্ন।
তার আশেপাশের মানুষের কী করা উচিত?
ড. মেহজাবীন হক: কখনো বসে বসে উপদেশ দেওয়া যাবে না। আত্মহত্যা কথা মাথায় এলে ভাবতে হবে, বাবা মার কথা। তাদের কথা চিন্তা ভাবনায় নিয়ে আসতে হবে। ইত্যাদি। কারণ লজিক নেওয়ার মতো অবস্থায় সে তখন থাকে না। সে ইমোশনাল আছে তাকে ইমোশনালি দেখতে হবে। তার কথা শুনতে হবে। তার কষ্টের কথা গুলো তাকে বলতে দিতে হবে। একজন যদি খুব মনোযোগ দিয়ে খুব আন্তরিকতা দিয়ে তার কথাগুলো শোনে সে অনেকটা হালকা হয়ে যাবে। এরপরই সে আত্মহত্যার স্টেপ গুলো আর নিবে না। এরপরই তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে।
আত্মহত্যার ঘটনায় তুলনামূলকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি কেন?
ড. মেহজাবীন হক: এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মূখ্য বিষয় না। এটা বিষয় না। এই প্রতিষ্ঠানে চাওয়া পাওয়ার জায়গাটা অনেক বিস্তৃত। মুক্ত এলকা। বেদনার জায়গাটাও অনেক বেশী। তাছাড়া এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি এটাও একটা বড় ব্যাপার। এখানে প্রতিযোগিতা বেশি, শহরে থাকতে হচ্ছে, নানা রকম জটিলতা মানুষের থাকে। জীবনের হিসাব-নিকাস মিলাতে অনেক সময় অনেক কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সেই হিসাবের খাতাটা মিলাতে না পারলেই ব্যর্থতার ছাপ পড়ে। হতাশা আগলে ধরে। ফলে বেঁছে নেয় ভয়ঙ্কর এই পথ।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে বা মানসিক সমস্যায় থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আপনারা কীভাবে সহায়তা করেন?
ড. মেহজাবীন হক: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে টাইম টু টাইম নানা রকম কর্মশালা ও ট্রেইনিং এর ব্যবস্থা করি। যেখানে যেকোনো শিক্ষার্থী এটেন্ড করতে পারে। এবং ইনডিভিজুয়াল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা আছে। যেকোনো শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা যেমন তাদের লেখাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে, আর্থিক সমস্যা হচ্ছে যেকোনো ধরণের সমস্যা হলে আমরা বলি আমাদের এখানে আসতে। মানসিকভাবে স্ট্রং না হওয়ার কারণে লাইফের যে এডভান্স ধাপগুলো থাকে এসবের সাথে তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। ফলে তাল মিলাতে সমস্যা হয়। সামাজিক দক্ষতার সমস্যা হয়। কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে কমিউনিকেট করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে ভয়ে থাকে। হলে অনেকরকম সমস্যা হয় এগুলো নিয়ে তারা আতঙ্কে থাকতে পারে। বাবা মায়ের সাথে সমস্যা, যেহেতু ইউনিভার্সিটি তাই এই বয়সে অনেকেই সম্পর্কে জড়ায়, এই রিলেশনশিপ নিয়ে সমস্যা সৃস্টি হয়। ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে আসলে বিনামূল্যে আমরা কাউন্সিলিং সেবাটা দিয়ে থাকি।
শিক্ষার্থীরা উপদেষ্টাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। তাঁদের জন্য কর্মশালার ব্যবস্থা করি। তাদের বলে রাখি তারা যেন শিক্ষার্থীদের আচরণের দিকে খেয়াল রাখেন। যেমন একজন শিক্ষার্থী আগে ভালো রেজাল্ট করতো কিন্তু এখন খারাপ করছে। কিংবা আচরণে কোন সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদেরকে আপনারা আমাদের কাছে রেফার করবেন। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ করেন, ড্রপ আউট হন, ডিপ্রেশনে চলে যায়। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, প্রভোস্ট আমাদের কে এসবে শিক্ষার্থীদের রেফার করেন। যখন তারা আমাদের কাছে আসেন আমরা তাদের দেখাশোনা করি। যাদের প্রয়োজন হয় তাদের আবার সাইক্রিয়াটিস্টদের কাছে রেফার করি এই কাজগুলা আমরা সারাবছর করি।
কাউন্সিলিং কতটুকু কার্যকর এবং এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু সফল?
ড. মেহজাবীন হক: যখন ড. ফয়েজ আহমেদ ভিসি ছিলেন তখন মেয়েদের হলগুলোতে হটাৎ সাংঘাতিক আত্মহত্যা বেড়ে গিয়েছিলো। আজকে সুফিয়া কামল হল তো কালকে রোকেয়া হল পরেরদিন কুয়েত-মৈত্রি হল একেবারে অনেকগুলো ঘটনা ঘটলো। তখন আমরা প্রত্যেকটি হলে হলে যেয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করলাম। কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে আত্মহত্যার লক্ষণগুলো সম্পর্কে অবগত করলাম। এরপরে তারা ধরতে পারলো কার কার সমস্যা হচ্ছে তারপর তারা তাকে কনভিন্স করে,গল্প করে বুঝিয়ে সাহায্যের জন্য নিয়ে আসলো। এরপর আমরা ফয়েজ স্যারকে বলে প্রত্যেকটা হলে বাধ্যতামূলক একজন মনোবিজ্ঞানীর পদের সৃষ্টি করতে বলি। এখন মেয়েদের প্রত্যেক হল আর ছেলেদের মধ্যে অমর একুশে হলে মনোবিজ্ঞানী আছে। তখন কিন্তু আত্মহত্যার সংখ্যা টা দ্রুত কমে গেলো। এই জায়গাগুলো ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডল করতে হবে। যার যেটা কাজ প্রফেশনালওয়ে তার সেটা হ্যান্ডল করতে হবে। এখন আমরা তাদের সাইকোলজিস্ট বা সাইক্রিয়াটিকসের কাছে পাঠাতে পারি। কখনোও দুইটি লাগবে। তার মধ্যে কী যে সমস্যা চলছে সেটা চিহ্নিত করে কাজ করতে পারলে আমরা আত্মহত্যার সংখ্যাটা কমিয়ে আনতে পারবো। তবে একদম বন্ধ করতে পারবো না। কারণ সবারই একটা লিমিটেশন থাকে।
যেসব শিক্ষার্থী নিজের মানসিক অবস্থা অন্যদের সাথে প্রকাশ করতে চায় না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. মেহজাবীন হক: এদের জন্য হলো ওদের বন্ধুরা। তাদের জন্য আমরা সচেতনতামূলক প্রোগ্রামগুলা করি। বন্ধুরা বুঝবে আমি কী করে বুঝবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর কার মধ্যে কী আছে সেটা আমি কী করে বুঝবো। যদি তার বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ না পায় তার শিক্ষকও সেটা বুঝতে পারবে না। সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে তার বন্ধুরা। কারণ বন্ধুরা তার পাশে থাকে। বন্ধুরা কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো ধরতে পারে। এই জন্য বন্ধুদের সচেতন হতে হবে। বন্ধুরাই শুরুতে এই পরিবর্তনগুলো ধরতে পারে। ধরো এখন যদি কারো করোনার লক্ষণ দেখা দেয় সেটা আমরা বুঝতি পারি তখন আমরা টেস্ট করাতে নিয়ে যাই। সেটা হলো করোনা নিয়ে মানুষের সচেতনতার ফল। এইজন্য আত্মহত্যা নিয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। কোন সমস্যা নাই, আমার মধ্যে কোনদিন আত্মহত্যার চিন্থা আসে নাই আমি এসব জেনে কী করবো। না, তোমার নাই কিন্তু তোমার পাশের জনের তো সমস্যা হতে পারে। তুমি তাকে সাহায্য করতে পারো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, এসব নিয়ে কোন স্ট্যাডি হয়?
ড. মেহজাবীন হক: সব আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে স্ট্যাডি করিনি। তবে ২০১৮ তে যে কয়েকটা ঘটনা ঘটলো এর মধ্যে তিনজনই ছিলো ইভিনিং এবং সাত কলেজের আর চারজন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে একজন পাশ করে চলে গেছে। তরুণ প্রজন্মের একটা সম্পর্কে থাকে। নিজের কাউকে ভালো লাগতে পারে, সম্পর্ক হতে পারে আবার ভালো না লাগলে ব্রেকআপ হতেই পারে। কিন্তু সকলের সেটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তখন আরেকজনের উপর রাগ করে, জেদ করে আত্মহত্যা করে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেকের মধ্যে এই সমস্যাগুলো আগে থেকে ছিলো। কিন্তু কেউ হয়তো বুঝতেই পারে নাই। আরেকটা ঘটনা আছে খুবই মেধাবী ছাত্রী, বিতর্ক করে, নাচ-গান করে, কিছু সমস্যার জন্য সাইক্রিয়াটিকের কাছেও যেতো। সারাক্ষণ হাসিখুশি থেকে রাতে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করলো। এইরকমও ঘটনাও ঘটে। আমরা সচেতন হলেই অনেক জীবনকে আমরা বাঁচাতে পারবো।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যার দিকে বেশি ঝুঁকছে?
ড. মেহজাবীন হক: যে বাচ্চাটা ছোটকাল থেকে 'না' শব্দ টা শোনে নাই; বাবা মা সবই দিয়েছে। কোনদিন বিপদে পড়ে নাই। বিপদে পড়ছে দেখলেই বাবা মা এসে উদ্ধার করে দিয়েছে। এই বাচ্চা টা বড় হয়ে জানেই না বিপদে পড়লে কীভাবে সার্ভাইব করতে হয়। আমাদের দোষ আছে। আমরা বাচ্চাদের স্কুল ফিডিং করে বড় করছি। সে জানেই না কীভাবে নিজের খাবার টা নিজের সংগ্রহ করতে হয়। বড় হয়ে যখন সে দেখে যে কেউ থাকে রিজেক্ট করছে, কিছু চেয়ে পাচ্ছে না, তখন সেটা সে মেনে নিতেই পারে না। সেটা পরীক্ষার ফলই হোক, পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হোক বা গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের রিজেক্ট। এভাবেই পার্সোনালিটির প্যাটার্ণ টা গড়ে উঠে।
আমাদের বাঙালি পরিবারে বাচ্চাদের এত বেশি অবমাননা করা হয় সেটা খুবই হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমরা কেবল উঠছি। কিন্তু বাচ্চাদের উপর নিজের চাহিদা আমরা এত বেশি চাপিয়ে দিই অথচ তাদের প্রয়োজন কিংবা চাওয়া পাওয়া গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এছাড়া আমরা অনেক কেইস পাই যেখানে শিশুরা মানসিকভাবে, শারিরীকভাবে, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট হয়েছে যেগুলো তাদের মনে একটা পার্মানেন্ট ক্ষত তৈরি করে। যেটা তাদের পার্সোনালিটি মেইকআপের উপর প্রভাব ফেলে। বাচ্চার ইমোশনাল দিকগুলো বিবেচনা না করে নিজেদের চাহিদা তাদের উপর দিয়ে আদায় করতে চায়। এসব কিছুই তাদের আত্মহত্যার দিকে অনেকক্ষেত্রে ঠেলে দেয়।
বুলিং মানসিক স্বাস্থ্যে কীভাবে প্রভাব ফেলে?
ড. মেহজাবীন হক: বন্ধুরাই অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দেয়। এখন মজা করার নামে বুলিং করা হয়। বুলিং করে একজনকে কিনারে ঠেলে দেওয়া হয়। তোমরা জানো না তার সমস্যা কী। তুমি হয়তো নিজের সাথে তুলনা করে বলছো আরে আমি এরকম ও এইরকম না। ওর জীবনে কী হয়েছে তুৃমি জানো না। ওর অভিজ্ঞতা আর তোমার অভিজ্ঞতা এক নয়। ও হয়তো মানুষের কাছে মর্যাদা পায় নাই। ও হয়তো আদরই পায় নাই। ওর হয়তো মা নাই। তার পরিবারের গঠন টা এইরকম। প্রথম প্রথম হয়তো তার তেমন কিছু মনে না হতে পারে কিন্তু বারবার বললে তার খারাপ লাগা শুরু করতে পারে। তুমি মজা করে যেটা নিতে পারো সেটা আরেকজনের ভালো নাও লাগতে পারে। তাই মানুষকে অবমাননা করে, প্রত্যাখ্যান করে কথা বলাটা মোটেও উচিত না। একজন ব্যক্তির একটা কাজ খারাপ হতে পারে কিন্তু ঐ ব্যক্তিটাকে খারাপ বলা যাবে না। ব্যক্তির পাপ কে ঘৃণা করো,ব্যক্তিকে রিজেক্ট করো না।
আত্মহত্যার খবর প্রচারে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
ড. মেহজাবীন হক: আত্মহত্যার খবর ফালাও করে প্রচার করা উচিত না। যখন দেখবে যে একজন সেলিব্রিটি আত্মহত্যা করেছে এর পরই কিন্তু অনেক ভক্ত আত্মহত্যা করে। কখন কীভাবে আত্মহত্যা করেছে, দড়ির ছবি,ওষুধের নাম, কেন আত্মহত্যা করেছে বিস্তারিত কখনোই প্রচার করা যাবে না। শুধু আত্মহত্যা করেছে এটাই প্রকাশ করা যাবে। কারণ আরো অনেকের মধ্যে একই ধরনের মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। একইধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এমন হতে পারে। ফলে এটা তাঁকেও একটা পথ দেখিয়ে দেয়। সে ভাবে যে আমিও তো এভাবে মুক্তি পেতে পারি। সেটা তাকে আত্নহত্যার পথে ঠেলে দিতে সাহায্য করে। যিনি আত্মহত্যা করেছেন তাকে হাইলাইট করে মহান করে তুলবো না, আত্মহত্যা কে মহান করে প্রচার করবো না। কিন্তু তাকে ছোটও করবো না। যাস্ট আত্মহত্যার একটা ঘটনা ঘটেছে এতটুকু।
আপনাদের কাছে গড়ে আনুমানিক কতজন শিক্ষার্থী পরামর্শ নিতে আসেন?
ড. মেহজাবীন হক: এটা সময়ের উপর নির্ভর করে। তবে প্রায় দশ-বারো জন শিক্ষার্থী তাদের কস্টের কথা, তাদের বেদনার কথা আমাদের শেয়ার করতে আসে। আমরা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে তা শুনে সমাধানের চেষ্ঠা করে থাকি।
আপনাদের লোকবল কতজন আছে?
ড. মেহজাবীন হক: কাউন্সিলর হিসেবে একজনের পদ আছে। কিন্তু একজন তো আর সেটা করতে পারে না। ক্লিনিকাল সাইকোলজি এবং এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের এর মাস্টার্সের শিক্ষার্থী যাদের আমরা উপযুক্ত মনে করি তারা এখানে রুটিনভিত্তিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। মোটামোটি চক্রাকারে ৩৫-৪০ জন শিক্ষার্থী হবেন কাজ করেন।
করোনা কালে আপনাদের কার্যক্রম কি ছিলো বলে মনে করেন?
ড. মেহজাবীন হক: করোনাকালে সরাসরি কাউন্সিলিং সম্ভব হচ্ছেনা। কিন্তু অনলাইন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালু রেখেছি। শুরুতে কোভিড-১৯ নিয়ে যখন মানুষ আতঙ্কে ছিলো তখন তাদের মনসিক সাপোর্ট দিতে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালু করেছি। সব কথার শেষ কথা, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি টানাপোড়ন থাকে। জীবনে সংগ্রাম থাকবে। বঞ্চনা থাকবে। অপমান থাকবে। বিশ্বাসঘাতকতা থাকবে। এগুলো থাকতেই পারে। প্রত্যেকটা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে আমি কি শিখলাম সেটা থেকে আমি শানিত হয়ে শক্ত হয়ে বেরিয়ে আসবো। মানুষের বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নানান সমস্যায় আমরা দরদী মন নিয়ে নিবির তত্ত্বাবধান করে শান্তির পথে আহবান জানাই। তাদের জন্যে আমাদের আপ্রাণ চেষ্ঠা অব্যাহক রয়েছে।
সৌজন্যে- মিজানুর রহমান, ক্যাম্পাসলাইভ২৪.
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন