একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ ভাগেরই বেশি ছিলেন তরুণ
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ ভাগেরই বেশি ছিলেন তরুণ
যুগে যুগে জগতে গীত হয়েছে তরুণ ও তারুণ্যের জয়গান। প্রবীণের প্রজ্ঞা ও পরামর্শ, নবীনের বল-বীর্য, সাহস ও উদ্দীপনায় পৃথিবীতে আসে পরিবর্তন। অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঝুঁকি নিতে পারে শুধু তারুণ্য। তরুণ বা নওজোয়ানদের অসাধ্য কিছু নেই। প্রথা ভাঙায় দুঃসাহস দেখাতে পারে শুধু তরুণেরাই। স্থলে, পানিতে ও মহাকাশে—যেকোনো অভিযানে অভিযাত্রী হওয়ার যোগ্য শুধু তরুণেরাই। তাই তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তরুণ বা নওজোয়ানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন:
অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে,
না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে!
এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ,
তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ।
... ... ...
পাহাড়ে চড়িয়া নীচে পড়ে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
অজগর খোঁজে গহ্বরে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
চড়িয়া সিংহে ধরে কেশর—নৌজোয়ান!
বাহন তাহার তুফান ঝড়—নৌজোয়ান!
শির পেতে বলে—‘বজ্র আয়!’
দৈত্য–চর্ম-পাদুকা পায়,
অগ্নি–গিরিরে ধরে নাড়ায়—নৌজোয়ান!
কবির এসব কথা যে স্রেফ ভাবাবেগ নয়, তা আমরা দেখেছি আমাদের তরুণ বয়সে—সেই ষাটের দশকে। সে এক বিস্ময়কর সময়। প্রায় আমাদের বয়সী তরুণ-তরুণীরা এমন সব কাণ্ড ঘটিয়েছেন, যা মানুষ কল্পনাও করেনি। এবং তাঁদের সেই সব দুঃসাহসিক কাজ আমাদের মতো সাহসহীন তরুণদের পর্যন্ত করেছে উদ্দীপ্ত ও রোমাঞ্চিত।
তখন পর্যন্ত টেলিভিশন নামের বস্তুটির নাম শুনেছি মাত্র, তার ছবিটিও চোখে দেখিনি। রেডিও বলতে ঢাউস আকারের একটি বাক্স। খুব কম মানুষের ঘরেই তা ছিল। তাতে খবর ও গান শোনা যেত। কোনো দিন ঢাকার মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা হলে তার ধারাবিবরণী। রেডিও বলতে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ও আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র। দিনে খবর তিন বা সাড়ে তিনবার। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত ১১টায় একটুখানি। সারা দিন রেডিও চালু থাকত না। দেশ-বিদেশের খবর জানার, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীদের ভাষণ ও যুদ্ধবিগ্রহের সংবাদ জানার একমাত্র মাধ্যম। পত্রপত্রিকা ছিল অল্প, তার প্রচারসংখ্যা সীমিত। সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, পাকিস্তান অবজারভার ও মর্নিং নিউজ।
১৯৬১-র এপ্রিলে একদিন সন্ধ্যায় রেডিওর খবরে ঘোষিত হলো: সোভিয়েত রাশিয়ার নভোচারী ইডরি গ্যাগারিন ‘ভোস্টক-১’ মহাকাশযান নিয়ে মহাশূন্যে বিচরণ করে নিরাপদে মর্তলোকে প্রত্যাবর্তন করছেন। গ্যাগারিনের বয়স মাত্র ২৭। মহাশূন্যের কক্ষপথে তিনি ছিলেন ১০৮ মিনিট।
কোনো বৃদ্ধের পক্ষে সম্ভব ছিল না সাহস করে নভোযানে সওয়ার হওয়া। কারণ, বৃদ্ধরা জানেন মহাশূন্য থেকে বেহেশত/স্বর্গের দূরত্ব যত কাছে, মাটির পৃথিবীর দূরত্ব তার থেকে ঢের বেশি। প্রবীণেরা আগে ভাববেন ফিরে আসা যাবে কি না এবং তা না আসার বিকল্প একটাই—বেহেশতবাসী হওয়া বা স্বর্গারোহণ। দ্বিতীয়টির ভয়ে তিনি মহাকাশে চক্কর দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। অন্যদিকে একজন সাহসী তরুণ ভাববেন: মহাশূন্যে একবার যাই তো, ওখানে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই তো গেলাম! বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হবে না, কিন্তু বিধাতার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তরুণ ঝুঁকি নেয়। তারই নাম তারুণ্য।
সাহস, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্ব জিনিসটি শুধু কি তরুণদের—তরুণীরা নেই কেন? ২৭ বছর বয়সী গ্যাগারিনের গৌরবগাথার রেশ মিইয়ে যেতে না যেতেই তারুণ্যের আরেক দৃষ্টান্ত। এবার নারী। তাঁর বয়স আরও কম। ভালেন্তিনা তেরেস্কোভা, বয়স ২৬। ১৯৬৩-র জুনে তিনি ‘ভোস্টক-৫’ নিয়ে মহাকাশ ঘুরে আসেন। মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবী, যিনি মহাকাশের কক্ষপথে বিচরণ করার গৌরব অর্জন করেন। তেরেস্কোভাই প্রথম নারী নভোচারী। তিনি নারী-তারুণ্যের প্রতীক।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশের কক্ষপথে তরুণ ও তরুণীদের পাঠাবে আর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র বসে বসে চেয়ে চেয়ে দেখবে, তা হতেই পারে না। তার চোখ চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহের দিকে। মার্কিন তরুণ-তরুণীরা মহাশূন্যে অভিযানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯-এ নিল আর্মস্ট্রংয়ের নেতৃত্বে তিন তরুণ নভোচারী ‘অ্যাপোলো-১১’ নিয়ে এদিক-সেদিক নয়, সোজা চাঁদে গিয়ে নেমে পড়েন। সে এক বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য ঘটনা। তত দিনে উপমহাদেশের প্রথম টেলিভিশন ‘পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা’ চালু হয়েছে। খবরের কাগজে আট কলাম শিরোনাম। রেডিও ও টেলিভিশনের শীর্ষ সংবাদ: নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স চাঁদের চত্বরে পদার্পণ করেছেন। ১১ জুলাই ১৯৬৯। তিন তরুণের তারুণ্যের সাহস বটে। চাঁদমামার কল্পলোকে পৌঁছাতে তাঁদের লেগেছিল ৮ দিন ১৪ ঘণ্টা ১২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। সেই স্বপ্নজগতে তাঁরা পায়চারি করেন ২ ঘণ্টা ৩১ মিনিট। সে পায়চারি বুড়ো মানুষের পার্কের ভেতর বৈকালিক হাঁটাহাঁটি নয়। ওখান থেকে যদি তাঁরা সহিসালামতে প্রিয়জনের কাছে ফিরে না আসতেন? মহাকাশ গবেষণায় অসংখ্য প্রবীণ বিজ্ঞানীর অবদান অপরিমেয়। কিন্তু জীবন বাজি রেখে অনিশ্চিত যাত্রায় বেরিয়ে পড়ার দুঃসাহস শুধু তরুণদের থাকে—প্রবীণ ও বৃদ্ধের নয়। তাঁরা জীবনের ব্যাপারে অতি হিসাবি। তরুণেরা তা নয়।
কেউ ভাবতে পারেন, শুধু মহাকাশে গেলেই তারুণ্য ও সাহসের প্রকাশ ঘটে, অন্য কিছুতে নয়, তা নয়। তারুণ্যের প্রকাশ ঘটতে পারে জীবনের ও জাগতিক যেকোনো ব্যাপারে। সেটাও আমরা ষাটের দশকে দেখেছি। তরুণেরা স্থিতাবস্থা পছন্দ করেন না, তাঁরা পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। বহু বড় বড় প্রবীণ ও বৃদ্ধ দার্শনিক ছিলেন তাঁর দেশে, তাঁদের তত্ত্বের মূল্য বিরাট, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য পথে নামলেন মার্টিন লুথার কিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম। লাখো মানুষ তাঁর পেছনে। রাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে। কোনো তত্ত্ব নয়—তাঁর ছিল একটি স্বপ্ন। ১৯৬৩-তে ওয়াশিংটনে তাঁর লংমার্চের কথা শুনে এবং তাঁর স্বপ্নের ঘোষণায় ঢাকা থেকে আমরাও উদ্দীপিত হই: আমাদের পক্ষেও স্বাধিকার অর্জন কঠিন নয়। মাত্র ৩০-৩২ বছরের তরুণ মার্কিন লুথার কিং।
কিং কালো ও পুরুষ। সাদা ও নারী অ্যাঞ্জেলা ডেভিস। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার, সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তি শক্ত করতে দুঃসাহসী তরুণী অ্যাঞ্জেলা ষাটের দশকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রায় আমার বয়সী একটি মেয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছেন দুঃশাসকদের ভিত। অশেষ ষড়যন্ত্র রাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের। অবিচল অ্যাঞ্জেলা। কর্তব্য থেকে কোনো কিছুই তাঁকে নড়াতে পারেনি। কোনো নির্যাতনও নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে লায়লা খালেদ বিমান ছিনতাই করে এমন নাড়া দিলেন, উপায় হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু লক্ষ্য হিসেবে অপ্রশংসার নয়। ইসরায়েল কীটপতঙ্গের মতো মানুষ মারবে, ফিলিস্তিনি কোনো তরুণ-তরুণী তা কত দিন সহ্য করবেন?
তারুণ্য হলো আগুন, তাকে দুভাবেই ব্যবহার করা যায়। মানুষের কল্যাণে এবং ধ্বংসাত্মক কাজে। তারুণ্য যখন মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়, তা দিয়ে অন্যায়-অবিচার দূর করা সম্ভব। দেশে দেশে মুক্তিসেনারা যে কাজটি করেন। একাত্তরে বা তারও আগে বাংলাদেশের তরুণেরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যে ভূমিকা পালন করেছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের তরুণদের অনেকের ভূমিকা গৌরবজনক।
যে আগুন মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ভস্ম করে, সে আগুনকেই মানুষের ভয়। ধ্বংসাত্মক কাজেও তরুণেরা ব্যবহৃত হন, তার পরিণাম তাঁদের জন্য যেমন খারাপ, তেমনি সমাজের জন্যও। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ ভাগেরই বেশি ছিলেন তরুণ, যাঁদের বয়স ৪০-এর নিচে। রাজাকার-আলবদরদের খাতায় যারা নাম লিখিয়েছিল, তাদেরও বেশির ভাগই তরুণ। ইসলামিক স্টেট বা আইএসসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রায় সবাই তরুণ। বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদে যারা দীক্ষিত বলে শোনা যায়, তারাও আমাদের যুবসমাজের একটি পথভ্রষ্ট গোত্র। কেউ কেউ কোনো কোনো পথ বেছে নেয় বিশ্বাস থেকে, কিন্তু অনেকেই বিপথগামী হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। আগামী ১৫ বছর পর তাঁরাই রাষ্ট্রের ও সমাজের সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের মেধা ও প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে না দিলে তাঁরা যে শুধু অযোগ্য নাগরিক হবেন তা নয়, তাঁদের একটি অংশ বিপথগামী হতে পারে।
আমাদের ছেলেমেয়েদের যোগ্যতার অভাব কোথায়? তাঁদের কেউ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতের চূড়ায় গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা পুঁতে আসছেন। কেউ ক্রিকেটে অসামান্য কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, আমাদের তরুণীরা ফুটবল মাঠে অন্য দেশকে হারিয়ে দিচ্ছেন, অনেকে পৃথিবীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। আমাদের শিক্ষার মান আজ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নিচে নেমে গেছে। সে জন্য দায়ী আমাদের ছেলেমেয়েরা নয়—সরকারের ভুল নীতি। আমাদের যুবসমাজের কাছ থেকে তখনই আশা করতে পারি, যখন তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে যাবতীয় সহযোগিতা দেব। কাউকে কিছু না দিয়ে তার থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না। যোগ্য তরুণসমাজ জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের কাছে জাতির অনেক আশা ও দাবি। তবে রাষ্ট্রের কাছেও তাদের দাবি কম নয়। সেই দাবি পূরণ কোনো দয়া নয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন