ছাত্রাবস্থা। ঢাবির হলে থাকি। টিউশন করি না। আমার চাহিদা ছিল অল্প। মাসিক খরচের খাত মোটামুটি ফিক্সড- অধিক অর্থের কখনো দরকার পড়ে নাই। একবার কী এক প্রয়োজনে মাসের অর্ধেক পেরোতেই মাসওয়ারি পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেলো- সাকুল্যে ৫০ টাকার একটি নোট সস্তা ওয়ালেটের কোণায় পড়ে আছে! চাইলেই বাবা টাকা পাঠাবেন, ঢাকা শহরে চাচা- মামা সবাই আছেন। কিন্তু নিজের কাছেই কুণ্ঠা লাগছিল, লজ্জা আর সংকোচ। বাপের টাকায় বিলাসিতা করাকে অপছন্দ করতাম। কেউ আমার সম্পর্কে তেমন ধারণা লাভ করুক তাও চাইতাম না। মাসের অর্ধেকের সময় পুরো টাকা শেষ হয়ে বেশ বেকায়দায় পড়লাম। ৫০ টাকার শেষ নোট টি নিয়ে শাহবাগের রাস্তায় বিকেলে নিরুদ্দেশ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি- কী করা যায়!
আজিজ মার্কেটের নিচতলায় কাবাব বিক্রির একটি দোকান ছিল। ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে কাবাব ভাজা চলছে। ঢুকে পড়লাম। পৃথিবীর কোন এক তরুণের শেষ সম্বল ৫০ টাকা পেটে চালান করে দিয়ে কপর্দকশূন্য- সর্বস্বান্ত হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম! টাকা না থাকার অনুভূতি কেমন সেটি প্রথম উপলব্ধি করা গেলো। সেই অনুভূতি এমন ভয়ংকর ছিল যে পরেরদিন হতেই স্বাবলম্বী হতে সচেষ্ট হলাম। তবুও বাসায় জানাইনি।
বন্ধু Moin Tareq আর Mahmudul Hossain সহ ধানমণ্ডি এলাকার একটি কোচিং সেন্টারের প্রচারের কাজ নিলাম- দৈনিক পারিশ্রমিকের চুক্তিতে ঢাকা শহরের স্কুলগুলোর মেইন গেইটের সামনে বসে থাকা মা-বাবা ও অভিভাবকদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে- কথোপকথনের মার্কেটিং কৌশলে কনভিন্স করার কাজটি উপভোগ করেছি, হীনমন্যতায় ভুগিনি। নানান মজার সব ঘটনা ঘটেছে সেই সময়। আজ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে লেকচার দেই- মনে হয় অন্যকে ইম্প্রেস ও কনভিন্স করার দক্ষতাটি সেদিনের পরিশ্রমের ফলাফল।
পৃথিবীতে টাকা খুবই দরকারি জিনিস। এটি না থাকলে মানুষ হীন বোধ করে, আত্মমর্যাদা হারানোর গ্লানিতে পড়ে যায়। দারিদ্র্য অভিশাপ। আবার মা-বাবার বা অন্যের টাকায় বিলাসিতা করার মাঝেও কোন আত্ম মর্যাদা নাই, গৌরব নাই। শিক্ষার্থীদের উচিত কোন কাজ কে ছোট করে না দেখা, হীনমন্যবোধ না করা। কোন পরিশ্রম, কোন পারিশ্রমিক অকিঞ্চিৎকর নয়, অগৌরবের নয়। ছাত্রাবস্থায় পার্ট টাইম উপার্জন করার সংস্কৃতি বিশ্বজনীন। বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী লোকেরাই উন্নত দেশে গিয়ে রেস্টুরেন্টের ওয়েটার আর থালা-বাসন মাজনেওয়ালা হতে লজ্জা পায় না। কিন্তু বাংলাদেশে এক টিউশনি আর কোচিং ক্লাস ছাড়া যেন শিক্ষার্থীদের আর কোন উপার্জনক্ষেত্র নাই! আমি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পার্ট টাইম উপার্জনের অফার দিয়ে দেখেছি, ভাবখানা এমন- ছ্যাহ! এই কাজ ক্যাম্নে করবো- মান- ইজ্জত ফালুদা হয়ে যাবে! অথচ তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা- ভিক্ষার হাত পাততে দ্বিধা নাই কিন্তু বৈধ শ্রমে আপত্তি!
এই অগৌরবময় আত্মগরিমার সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন