আল নাহিয়ান খান জয়
সময়ের প্রয়োজনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এটি কেবল একটি সংগঠন হিসেবে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন—অর্থাৎ এদেশের সব ক্রান্তিকালে গণমানুষ সবসময় পাশে পেয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে।
বাঙালির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এ-সংগঠন শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি এই স্লোগানকে সামনে রেখে পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তব জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, বিনয় ও ভদ্রতা, জীবনের সঙ্গে দেশপ্রেম, সততা ও নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে দুর্বার গতিতে।
সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নানা চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করেছে। পাড়ি দিয়েছে কণ্টকাকীর্ণ পথ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামেই জন্ম হয় আজকের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ যখন শৈশব পার করেনি, তখনই তাকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হয়েছে ভাষা আন্দোলনে। চুয়ান্ন’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় মাঠ পর্যায়ে ছাত্রলীগ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক গঠিত শরিফ কমিশন পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের অনুকূলে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলন গড়ে তোলে। যার ফলস্বরূপ স্বৈরাচারী আইয়ুব নেতৃত্বাধীন সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা পেশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বভাবতই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী একে চক্রান্ত হিসেবে প্রচার করতে থাকে। নিজের নৈতিক অবস্থানে অনড় থাকেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বুঝতে পারেন, দেশব্যাপী ছয়দফার প্রচার জরুরি। ছাত্রলীগের ওপর আস্থা রেখে তিনি সংগঠনটির নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, জেলায় জেলায় অবস্থান সুসংহত করে ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে। বঙ্গবন্ধুর রাখা এ আস্থার প্রতিদান দিয়েছিল ছাত্রলীগ। সংগঠনের নেতাকর্মীরা সারা বাংলার মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা দাবির গুরুত্ব তুলে ধরেছিল জোরালোভাবে।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল রাজপথে। সিরাকিউসের রাজা অডিসিউসের মতো সামনে থেকে এ গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় সংগঠনটি। যার ফলে স্বৈরাচার আইয়ুবকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কিছুটা বিভেদ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সেদিন যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আওয়ামী লীগের বৈঠকের বাইরে কঠোর পাহারা বসাতে হয়েছিল ছাত্রলীগের কর্মীদেরই।
১৯৭০-এর নির্বাচনে মাঠ-পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখে ছাত্রলীগ। জনগণকে ছয়দফার গুরুত্ব বোঝাতে, সরকারি অপপ্রচারের জবাব দিতে, ভোটারদের নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন করতে নিরলস কাজ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের দীর্ঘ পথচলায় ছাত্রলীগ হারিয়েছে তার হাজারো নেতাকর্মীকে। এ সংগঠন জুলুমকারীর সঙ্গে কোনোদিন আপস করেনি। জনগণের অধিকার ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করেনি। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে যে কোনও পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। ২৩ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবো। তবু সাক্ষাৎমৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করবো না।’ তাই তো মুক্তিযুদ্ধে এ সংগঠনের ১৭ হাজার বীরযোদ্ধা তাদের বুকের তাজা রক্তে এঁকেছেন লাল-সবুজের পতাকা, এঁকেছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক সার্বভৌম মানচিত্র। সেসব বীরযোদ্ধাই আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের শক্তি, আমাদের সাহস। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন