দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এদেশের যত অর্জন, আন্দোলন-সংগ্রাম আর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে আছে দলটির নাম। প্রতিষ্ঠার পর ৭০ বছর অতিক্রম করে আজ ৭১-এ পদার্পণ করল টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা এই দল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। সময়ের হিসেবে প্রাচীন দলের তকমা লাগলেও এখনো আওয়ামী লীগ চিন্তাভাবনা কর্মকৌশলে তরুণ। এই দীর্ঘ সময়ে ২০টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে দলটির। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হবে দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনেও তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে ঢেলে সাজানো হবে দলকে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে দলের হাইকমান্ড। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা দলটির মন্ত্রিসভায় রয়েছে তারুণ্যের চমক। তরুণ প্রজন্মকে দলে টানতে মাঠ পর্যায়ে চলছে সদস্য সংগ্রহ অভিযান। একাদশ সংসদের প্রথম বাজেটে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি তরুণের কর্মসংস্থানের ঘোষণা করা হয়েছে। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য কাজ করতে চান। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে, বিষয়টি জানাজানি হলে তৎকালীন সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ওই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করেন। তখন নতুন সংগঠন গড়ে তোলার কারিগররা মওলানা ভাসানীকে আত্মগোপনে রাখার ব্যবস্থা করেন এবং সম্মেলনের দুই দিন আগে তাকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে আসা হয়। এরপর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। সম্মেলনে দলের নাম দেওয়া হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরদিন ২৪ জুন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যে আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয়, দীর্ঘ ৭০ বছরে তার বিরাম নেই। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনো বিরোধী দলে, কখনো সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ নির্মাণের আদর্শ এবং একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনের ভিত্তি রচনা করে আওয়ামী লীগ। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৬-এর ছয় দফা এবং ’৬৯-এর গণআন্দোলনসহ দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি লাভ করে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠন ও বিশ্বসভায় স্থান করে নেওয়ার অগ্রযাত্রার মুহূর্তে পরাজিত শত্রুদের চক্রান্তে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। দেশ পাকিস্তান পন্থার প্রতিক্রিয়াশীলতার আবর্তে ডুবে যেতে থাকে। সেই দুর্দিনে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে ফিরে এসে দলের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বেই দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার করে আবার উন্নতির অভিযাত্রা শুরু করে। জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তিনি শহর থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। লড়াই করেছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আবার সরকার গঠন করে টানা সাড়ে ১০ বছর ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ। পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। এখন সারা দেশে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, পাতাল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, রেল, নৌ ও যোগাযোগ অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের দাবি, উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে দেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের প্রায় সম-আয়তনের সমুদ্রসীমা অর্জন করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় শান্তিচুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন মহাকাশের অংশীদার। গত বছরে আকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। দ্বিতীয় স্যাটেলাইট তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন করা হচ্ছে। বিনামূল্যে তরুণদের তথ্য প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার পাশাপাশি উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, এটা এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য তারুণ্যনির্ভর আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলা। দল ও সরকার নিয়ে সে পথেই হাঁটছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য দল ও সরকারে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে তারুণ্যকে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিগত মন্ত্রিসভার প্রবীণ ও কিছু বিতর্কিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় দলের জাতীয় সম্মেলনেও তারুণ্যের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের জন্ম মোটেই সুখকর ছিল না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দলটির নেতা-কর্মীদের নানা জেল-জুলুম-অত্যাচার সইতে হয়েছে। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনো বিরোধী দলে, কখনো সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সাতজন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে বর্তমান সভানেত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ সাতবার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুবার এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও আবদুল মালেক উকিল একবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন একবার দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয় শেখ হাসিনাকে। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পাহাড়সম শোক বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘরে-বাইরের নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয় তাকে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ ২১বার হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। আওয়ামী লীগে বড় ধরনের ভাঙন, তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন তিনি শক্ত হাতে।
প্রতিষ্ঠার ৭১ বছরে আওয়ামী লীগের অনেক সাফল্যের মাঝে ব্যর্থতাও রয়েছে। বড় সাফল্য ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল ভূমিকা। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকা কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও প্রবল শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখতে পারেনি দলটি। সাংগঠনিক অবস্থা ভিতরে ভিতরে যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতাও। সাংগঠনিক কর্মকান্ডে র চেয়ে দলটির কিছু নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের প্রধান লক্ষ্যই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মীয়-পরিজন বেষ্টিত হয়ে ক্ষমতার প্রতিপত্তি ধরে রাখতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি, নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য আর সরকারি লাভজনক কাজ নিজের করায়ত্ত করার নগ্ন প্রতিযোগিতা।
তবে আওয়ামী লীগের প্রধান কা ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার ওপর ভর করে এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। মাটি ও মানুষের দল আওয়ামী লীগের কাছেই জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সে প্রত্যাশা পূরণে কতটা এগোতে পারছে দলটি, এ জিজ্ঞাসা সবার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন