সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরিমান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ আত্মহত্যার মিছিলে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। কেউবা বর্তমান সমাজের কথিত আত্মমর্যাদার প্রধান মাপকাঠি জিপিএ-৫ না পেয়ে আবার কেউবা চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন! গত ৩ ডিসেম্বর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর মৃত্যুর পর আত্মহত্যার বিষয়টি প্রবলভাবে দেশে আলোচিত হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। অরিত্রীর এমন মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। যে মেয়েটি এ বয়সে প্রানবন্ত থাকবে, হইহুল্লোড়ে মেতে থাকবে তার এমন বয়সে চলে যাওয়া সত্যিই হৃদয়বিদারক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অরিত্রীরা কেন অকালে চলে যায় বা আত্মহত্যা করতে চায়? অরিত্রীর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে সে পরীক্ষায় নকল করেছে এবং তার ফলস্বরুপ শিক্ষকরা তার বাবা-মাকে অপমান করেছে যা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। আত্মহত্যা এবং অপমানের আগে কেন সে পরীক্ষায় নকল করেছে সেটা কি আমরা বুঝতে চেয়েছি? শিক্ষার্থীটি দেশের একটি প্রথিতযশা স্কুলে পড়তো, সে স্কুলে প্রায় সবাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে! ভালো ফলাফল না করাটা সেখানে সমাজের চোখে মারাত্মক অন্যায় এবং অপমানের! ঐ শিক্ষার্থীও সমাজের চোখে তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে যেকোনোভাবে হোক ভালো ফলাফল করতে চেয়েছিল। হয়তো কোন কারনে সে ঐ পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারেনি, তাই সমাজের অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য পরীক্ষায় অসুদুপায় অবলম্বন করেছে।
যখন শিক্ষাব্যবস্থা অরিত্রীদেরকে উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে যে, জিপিএ-৫ না পেলে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার তথা সমাজের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। তখন অরিত্রীরা মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়! এই উপলব্ধি জন্য কিন্তু দৃশ্যত এই শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই মেধাবী। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) থেকেই এই বৈষম্যের সূত্রপাত। পিইসিতে ভালো ফলাফল না করলে ক্লাস ফাইভের পর ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না। এরপর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) আর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে ভালো কলেজে অ্যাডমিশন মিলবে না। আর এইচএসসিতে ভালো ফল না করলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পিছিয়ে থাকতে হবে। এটি এখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত সত্য। আর এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রভাব পড়েছে সমাজের শিক্ষানীতিতে। আর শিক্ষানীতির প্রভাব ও চাপ গিয়ে পড়েছে অভিভাবকদের ওপর। আর অভিভাবকরা এই চাপ উগড়ে দিচ্ছেন কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ওপর। কিন্তু এটি বোঝার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি যে, এ প্লাস না পেলে মেধাবী নয়- এমন চিন্তাটিই সঠিক নয়। সমাজের এমন একচোখা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই গোগ্রাসে গিলে উগড়ে দিচ্ছে পরীক্ষার খাতায়। যার ফলাফলে ‘এ প্লাস’ অনেকেই পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত অর্থে পরিপূর্ণ মেধাবিকাশ হচ্ছে না কোথাও। আবার যারা পরীক্ষায় খাতায় উগড়ে দিতে পারছেনা তারা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। জীবনের পথে কাগুজে সার্টিফিকেটে ভালো নম্বর পাওয়ার ইঁদুরদৌড়ে ছুটতে গিয়ে এই কোমল প্রাণরাই ছিটকে পড়ছে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে। ছাপানো কাগজ যে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে না এ কথাটি উপলব্ধি করতেই পারছেন না শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকরা। পরিবার ও সমাজের এসব বঞ্চনা, গ্লানি পুরোটাই একতরফাভাবে বইতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে চারদিক থেকে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এই বাস্তবতায় জিপিএ-৫ না পাওয়া ১৫-১৬ বছর বয়সী কিশোর বা কিশোরীরা প্রচণ্ড মানসিক চাপ অনুভব করে এবং তা থেকে মুক্তি পেতে চায়। আর এই বয়সে এত বড় চাপ মোকাবিলায় সবাই সফল হয়ে উঠতে পারছেনা, ফলে ঝরে যাচ্ছে একেরপর এক প্রাণ। অপরদিকে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের উপর বিভিন্নভাবে প্রবল চাপ দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষকরাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারষ্পরিক সর্ম্পকের কথা ভুলে গিয়ে অমানবিক হয়ে যে করেই হোক জিপিএ-৫ বাড়াতে চায়। কারণ যে প্রতিষ্ঠান থেকে যত বেশি জিপিএ-৫ বাড়াতে পারবে সে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন তত বেশি শক্ত হবে। আর এটি করতে গিয়ে শিক্ষকরা হয়ে উঠছেন প্রচন্ড অমানবিক।
দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যতবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ততবার শিক্ষার প্রকৃত উদ্যেশ্য নিয়ে ভাবা হয়েছে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রকৃতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায় প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগই পায় না ছোট ছোট শিশু-কিশোররা। পিইসি, জেএসসির মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুরা তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে ফেলছে, নষ্ট করে ফেলছে তাদের সৃজনশীলতা। সারাক্ষণ চার দেয়ালে বন্দি থেকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য যে, সিলেবাস প্রণেতারা তরুণ শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সিলেবাস প্রণয়ন করেননি। বর্তমান সিলেবাস দেখলে মনে হচ্ছে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই একেকজন শিক্ষার্থীকে তাঁরা আইনস্টাইন, নিউটন বানাতে চান! এখনকার প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে সুকৌশলে পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে আনলেও প্রতিটি অধ্যায়ে অনুশীলনীমূলক কাজ দিয়ে সিলেবাসকে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে! অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন পদ্ধতিতেও আনা হচ্ছে জটিলতা। এমন অনেক বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য হওয়া সমীচীন। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যখন কোন একটি বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে না পারে, পড়াশুনার মাঝে যখন সে আনন্দের পরিবর্তে বিশাল বোঝা খুঁজে পায় তখন সে আস্তে আস্তে ঐ বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে চায়। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দের পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আনন্দহীন শিক্ষাব্যবস্থা, জিপিএ-৫ অসুস্থ প্রতিযোগিতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারষ্পরিক সর্ম্পকের অবনতি যতদিন দিন বন্ধ না হবে ততদিন অরিত্রীরা অকালে ঝরেই যেতে থাকবে।
মামুনুর রশিদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন