কাঁধে চিরাচরিত ব্যাগ আর হাতে কিছু বই। হেঁটে যাচ্ছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। কখনো কারো বাড়ির সামনে, আবার কখনো কোনো স্কুলের সামনে বই হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। হাসিমুখে পাঠকদের হাতে বই তুলে দেন। ফেরত নেন পড়ে শেষ করা পুরনোটি। কোনো জামানত নেই, চাঁদা নেই। বিস্তারিত জানাচ্ছেন জামিল আশরাফ খান
ইউনুছ খানের বয়স ২৯ বছর। বইয়ের ফেরিওয়ালা নামে চেনেন অনেকেই। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া ইউনিয়নের প্রায় ৮টি গ্রামে গড়ে তুলেছেন বইপড়ার অভিনব আন্দোলন। হাতভরা বই নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম-গ্রামান্তরে ছুটে যান। আর সেই বইগুলো মানুষকে পড়তে দেন। পড়া শেষ হলে দিয়ে আসেন নতুন বই। এভাবে একটানা ১৬ বছর ধরে করছেন এই কাজ।
বইয়ের গল্পের মতো তারও একটি গল্প আছে। এই কাজ করার পেছনের নেপথ্য গল্প। বই আর পত্র-পত্রিকার সঙ্গে তার সখ্যতা ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু শখ থাকলেও সাধ্য ছিলো না। তার গ্রাম তো দূরের কথা আশপাশের ১০-১২টি গ্রামেও ছিল না কোনো পাঠাগার। শখ মেটাতে যেতে হতো উপজেলা শহরে। তখন থেকেই নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার করা ও বইকে সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন জাগে। তার এসএসসি পরীক্ষার পর বন্ধু ও বড়ভাইদের মাঝে এই পরিকল্পনার কথা জানান।
কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দিলেও জাহাঙ্গীর কবির, শেখ জুটন, রেজাউল করিম, আবদুল্লাহ ইবনে মনির, দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই হাত মেলান তার সঙ্গে। তখন থেকে শুরু হয়ে গেল পাঠাগার আন্দোলন। ২০০১ সালের মাঝের দিকে মাত্র ৩০০ বই ও ১৯ জন পাঠক নিয়ে গড়ে তোলেন ‘মহামায়া গণপাঠাগার’। কিন্তু অনেকেরই পাঠাগারে আসার সুযোগ হয় না। তাদের জন্য তিনি বের করেছেন ঘরে বসে বই পাওয়ার অভিনব পদ্ধতি। তবে বর্তমানে তিনি একা নন, তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ উল্লাহ, জামাল উদ্দীন, শাওন, রাশেদ, আবুল কালামসহ অনেক তরুণ-তরুণী।
মহামায়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ইউনুছের। বাবা আবু তৈয়ব করেন কৃষিকাজ। গ্রামে তাদের কয়েকটা দোকানঘর। এই দোকানঘরগুলোর মধ্য থেকে একটা ব্যবহার করেন পাঠাগার হিসেবে। শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, হুমায়ূন আহমেদসহ অনেক লেখকের বই রয়েছে ইউনুছের স্বপ্নের পাঠাগারে।
বইপড়ার এই অভিনব আন্দোলনকে কেন এবং কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনুছ খান বলেন, ‘শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই সঠিকভাবে জ্ঞানার্জন সম্ভব না। আর বই পড়লে অন্যান্য খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। বই-ই পারে একমাত্র আলোর পথে নিয়ে যেতে। সবাইকে আলোর পথে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাঠাগারটি চালানো আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেকেই কমবেশি সাহায্য করেন। বিশেষ করে উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সহযোগিতা করেন। এছাড়া এলাকার অনেকে বই দিয়ে সহযোগিতা করেন।
ইউনুছের হাত ধরেই ৪৬ বছর বয়সী আবদুর রউফ হয়ে উঠেছেন বইপোকা। তিনি অবসর পেলেই পাঠাগারে ঢুকে হাতে নেন পত্র-পত্রিকা, গল্প ও উপন্যাসের বই। যতক্ষণ অবসর পান; ততক্ষণ বই পড়েই সময় কাটান তিনি। এখন তিনি শুধু নিজেই বই পড়েন না, বই পড়তে উৎসাহ দেন অন্যদেরও। আবদুর রউফ বলেন, ‘প্রতিদিনই পাঠাগারে আসা হয়, নিজের ইচ্ছামতো বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ি। আর কোনো কারণে না আসতে পারলে বই সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে পড়ি।’
কথায় কথায় জানা গেল, ইউনুছ খান বইপড়ার আন্দোলনকে শুধু একটি ঘরের মধ্যে (পাঠাগার) বন্দি না রেখে সব জায়গাতে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। পাঠাগার থেকে নেওয়া ও তার বিলানো বই নিতে পারেন যে কেউ। এরজন্য কোনো চাঁদা বা জামানতের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকেলে পাঠাগারে চলে সাহিত্য আড্ডা।
সাহিত্য আড্ডা ছাড়াও পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, গল্প-কবিতা লেখা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয় নতুন নতুন বই।
কিছুটা হতাশা নিয়ে ইউনুছ খান বলেন, ‘অনেকে বই নিয়ে ফেরত দেন না বা হারিয়ে ফেলেন। এতে পাঠাগারের বই কমে যাচ্ছে। নতুন বই কেনার মতো আর্থিক অসচ্ছলতা তো আছেই! পাঠাগার চালাচ্ছি কোনোমতে।’ এমনিতে পাঠাগার পরিচালনার ব্যয় মেটানোই ভার। তবে সহায়তা পেলে পাঠাগারটি আধুনিক ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ও পাঠকসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর বাইরেও অনেক পাঠক আছেন; যারা শুধু পাঠাগারে এসে বই পড়ে যান, কিন্তু নিবন্ধিত হননি। এখন দৈনিক গড়ে ১০০ থেকে ১২০ জন পাঠাগারে এসে বই পড়েন। বইয়ের পাশাপাশি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা পাঠদানের কার্যক্রমও দৃষ্টিনন্দন।
শুধু বইপড়া আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ নন ইউনুছ খান ও তার পাঠাগার। পাঠাগারের জন্মলগ্ন থেকেই বৃত্তি পরীক্ষা, কুইজ প্রতিযোগিতা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, চিকিৎসা ক্যাম্প, গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বই বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় দিবসগুলো বেশ ঘটা করে পালন করে পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। তাই তো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে মিলেছে স্বীকৃতি।
সারা জীবন এভাবেই বইপড়া আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান ইউনুছ। গ্রামের মানুষকে দিতে চান আনন্দময় এক জগতের খোঁজ। যে জগতের খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন বইয়ের ছাপানো অক্ষরে। সেই আনন্দের ভাগ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেই তিনি হাঁটেন মাইলের পর মাইল। সূত্র: জাগো জবস
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন