বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৭ মার্চ, ২০২০ থেকে বন্ধ রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকসহ অভিভাবকদের করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা ও সংক্রমণ যাতে না ছড়াতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করে এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস ধরে এ অস্বাভাবিক বিরতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই।
দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, টিভি দেখে ও মোবাইল ব্যবহার করে সময় ব্যয় করছে এবং যার দরুন তারা লেখাপড়ার অভ্যাস থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। যদিও শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে চলছে; তবুও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জীবনের অভাব নিছক অনলাইন ক্লাসে পূরণ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর এবং করোনার এ দুঃসময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিক্ষা।
আবার দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করা ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে একটু কঠিন হবে। এ ছাড়াও গত নয় মাসে দুই হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এ দুঃসময়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক সম্পূর্ণ বেকার হয়েছেন, অনেকেরই বেতন-ভাতা কমে গেছে এবং পরিবার নিয়ে আর্থিক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন।
শিক্ষা খাতের খরচ জাতির জন্য একটি সঠিক বিনিয়োগ হলেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব শিক্ষক-কর্মকর্তার জন্য তেমন কোনো সরকারি অনুদান নেই; যদিও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি প্রণোদনার প্যাকেজ রয়েছে। ৯ মাস ধরে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমভিত্তিক পাঠদান বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
কাজেই এসব কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে সরকারকে উকিল নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে সবকিছু খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ রাখা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। অন্য সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত? পশ্চিমা বিশ্বসহ উন্নত দেশগুলো এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা ভাবছে না।
কোনো কোনো দেশ সীমিত আকারে শুধু মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কানাডার কথা বলা যায়, সেখানে করোনা সংক্রমণ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা কমে যাওয়ার পর শুধু মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলগুলো গত সেপ্টেম্বরে খুলে দেওয়া হয়।
এরপর কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় টরেন্টো শহরের কয়েকটি স্কুলে করোনা টেস্ট করা হয়। এতে করোনা সংক্রমণের একটি ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে ওঠে এবং দেখা যায়, প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন করোনা পজিটিভ। তারপরও কানাডা সরকার কিছু কিছু শহর, যেখানে করোনার প্রাদুর্ভাব খুবই কম; শুধু সেসব শহরে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনলাইন ক্লাস অফার ছাড়াও কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী, যারা ক্লাসরুমে উপস্থিত হতে চায়, তাদের জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্কুলগুলো সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা রেখেছে।
এসব পশ্চিমা উন্নত দেশে মা-বাবা দুজনকেই কাজ করে উপার্জন করতে হয় বিধায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে ঘরে থাকলে তাদের দেখাশোনার জন্য মা অথবা বাবাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এ কারণে এসব দেশে অভিভাবকদের চাপেই কেবল মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কোনো কোনো ছোট শহরের স্কুলগুলো কিছু সময়ের জন্য খোলা রাখতে হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের সংখ্যার তুলনায় ক্লাসরুমগুলোর আকার অনেক বড়।
একেকটি বড় আকারের ক্লাসরুমে ১৫-৩০ জন শিক্ষার্থী ও দুজন শিক্ষক থাকেন। তারপরও কানাডা সরকার অনূর্ধ্ব ১২ বছর বয়সী শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাসায় রেখে অনলাইন ক্লাসে সহায়তার জন্য অভিভাবককে সপ্তাহে ৪৫০ ডলার পর্যন্ত ভাতা দিচ্ছে।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের ধারণক্ষমতার চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। সেক্ষেত্রে কখনই ক্লাসরুমের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক অভিভাবকের উপস্থিতি কখনই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কাজেই করোনার সংক্রমণ যে দ্রুতই ছড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোয় আমাদের দেশের মতো স্কুলপড়ুয়াদের অভিভাবকরা কখনই তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য বা পরীক্ষার সময় স্কুল প্রাঙ্গণে জমায়েত হয় না; তবুও সেসব দেশ স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। করোনাভাইরাস ছোট-বড়, ধনী-গরিব, ধার্মিক-অধার্মিক, শহর-গ্রামাঞ্চল ও পরিবেশের তাপমাত্রা চিনে সংক্রমণ করে না; বরং সংক্রমণ ও সংক্রমণের তীব্রতা শুধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
দেশের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে করোনা সংক্রমণ একেবারেই নেই বলে আমাদের যে ধারণা, তা কতটুকু সঠিক; তা জানা দরকার। গ্রামাঞ্চলে লোকসংখ্যার ঘনত্ব কম বলে সংক্রমণও কম হওয়ার কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবসতির দেশ চীন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণের হার কম জনবসতির দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি নিউইয়র্ক যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হওয়ায় অন্যান্য শহরের তুলনায় সংক্রমণের হারও বেশি। তেমনি বাংলাদেশের ঢাকাসহ অন্যান্য সিটিতে জেলা শহরের চেয়ে করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি।
করোনা শুধু আক্রান্ত বা করোনার বাহক এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হয়। একসঙ্গে যত বেশি লোকের সমাগম হবে, সংক্রমণের হার ততই বাড়বে। তাছাড়া, শিশু তথা কমবয়সি ছেলেমেয়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি। আবার গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহরের লোকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড় শহরের চেয়ে বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে রোদ-বৃষ্টিতে দৈনিক হাঁটাচলা, খেলাধুলাসহ অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (এক্সারসাইজ) এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণ।
প্রতিনিয়ত শারীরিক ক্রিয়াকলাপের কারণে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ও কম বয়সি ছেলেমেয়েরা শারীরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় করোনার সংক্রমণ ও সংক্রমণের গুরুতর লক্ষণগুলো হয়তো তেমন দেখা যাচ্ছে না। তবে এটা বলা যাবে না যে, গ্রামাঞ্চলে করোনা নেই; বরং স্বাভাবিক সর্দিকাশিসহ মৃদু লক্ষণযুক্ত সংক্রমণ ও করোনার বাহক সমানতালেই রয়েছে। তাই গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই খুলে দেওয়া কি উচিত হবে?
স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের জীবন রক্ষা ও করোনার ক্ষতিকর ছোবল থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের জন্য জরুরি, না লেখাপড়ার ক্ষতি জরুরি? সাময়িক সময়ের জন্য লেখাপড়ার ক্ষতিতে ত্যাগ স্বীকার না করে জেনেশুনে আমরা নিশ্চয়ই আমাদের ছেলেমেয়ে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারি না। নিশ্চয়ই করোনার কারণে একটি জীবনও বিপন্ন হোক, তা আমাদের কাম্য নয়।
স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার জন্য সরকার আন্তরিক নয়, এটি বলা ঠিক হবে না। সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরও শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পেছনে সরকারের কোনো বিশেষ লাভ নেই; বরং করোনাকালীন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাত নিয়ে নিশ্চয়ই সরকারেরও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। এ দুঃসময়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা দুটো রক্ষাই সরকারের দায়িত্ব।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব খাত বা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে দেশে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির কারণে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার অভাবেও মৃত্যুর ঘটনা হয়তো ঘটত। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতকে উদ্ধার করার দায়দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণসহ হালনাগাদ তথ্য সরকারের কাছে নেই- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অযথা চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। পরিস্থিতি অনুকূল হলেই নিশ্চয় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখবে না। সুতরাং, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইনভিত্তিক ক্লাস আরও জোরদার করাসহ বাড়িতে লেখাপড়া ও অন্যান্য সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে।
ড. মো. শফিকুর রহমান : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন