ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রকৌশল...কত রকম বিষয় আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। কোন বিষয়ে আমি পড়ব, সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন। স্বপ্ন নিয়ের এই বিভাগে আমরা একেকটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আজ রোবটবিজ্ঞান বা রোবটিকস সম্পর্কে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপারসন, অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিসহ সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন রোবটিকস পড়ানো হচ্ছে।
কী পড়ানো হয়?
নাম শুনেই কী কী পড়ানো হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। রোবট নিয়ন্ত্রণ, রোবটের নকশা করাসহ সার্বিকভাবে রোবট কীভাবে বানাতে হয়, সেটাই মূলত থাকে রোবটিকসের পাঠ্যক্রমে। এটি একটি ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ বা বহুমুখী বিষয়, যা মূলত কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, যন্ত্রপ্রকৌশল এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ‘অ্যাডভান্সড ম্যাথমেটিকস’ ও ‘প্রোগ্রামিং’–এর দিকে জোর দেওয়া হয়। কেননা রোবট পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপ আমাদের গাণিতিকভাবে হিসাব-নিকাশ করে বের করতে হয়—যা প্রোগ্রামের মাধ্যমে রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে থাকে ইলেকট্রনিকস ও মেকানিক্যালের প্রাথমিক কোর্স। সেখানে শিক্ষার্থীরা সার্কিটের নকশা করা, রোবটের যান্ত্রিক কাঠামো তৈরি, প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা—এসব শিখতে পারে। রোবটের নকশার জন্য তারা শেখে ক্যাড ডিজাইনিং এবং থ্রি-ডি মডেলিং। তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে মূলত বিশেষায়িত কোর্সগুলোতে জোর দেওয়া হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স), ইমেজ প্রসেসিং, রোবট ভিশন, মানুষ ও রোবটের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারেকশন), সিএনসি প্রোগ্রামিং, কন্ট্রোল সিস্টেম ডিজাইন—এগুলো শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়। এই বিভাগে পড়াশোনার মজার দিক হলো, এখানে প্রতিটি কোর্স গবেষণাগারনির্ভর। তত্ত্বীয় ক্লাসের পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার শেখা বিষয়বস্তু গবেষণাগারে হাতে-কলমে শেখানো হয়। ফলে তত্ত্বীয় কোর্স থেকে তারা যা শেখে, সেগুলো নিজেদের তৈরি রোবটে তারা সহজেই প্রয়োগ করতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী?
এই বিভাগে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের বর্তমানে নানা পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। কয়েক বছর আগেও প্রযুক্তিনির্ভর এই দুনিয়াতে প্রোগ্রামারের চাহিদা ছিল তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। ধীরে ধীরে সাধারণ প্রোগ্রামারের চেয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে, এমন প্রোগ্রামারের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটা সমীক্ষা বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কাজ নিয়ে নেবে রোবট, তবে একই সঙ্গে প্রায় ১৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষের নতুন কর্মবাজার তৈরি হবে। তার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, তৈরি করতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ। এসব কাজের মূল শুরু হবে রোবটিকসের হাত ধরে। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন রোবট প্রবেশ করছে। এ ছাড়া রোবটিকস মানে কিন্তু শুধু পায়ে হাঁটা বা চাকায় গড়ানো রোবট নয়। আমাদের চারপাশে ইলেকট্রনিকস পণ্যগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। যার মূল ধারা কিন্তু তৈরি করবে এই রোবটিকস জানা শিক্ষার্থীরাই। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, প্রসেস অটোমেশন, বিগ ডাটার ব্যবহার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেড়ে চলেছে। যেখানে রোবটিকস জানা মানুষের বিপুল চাহিদা তৈরি হবে।
পেশা কোথায়?
কাজের বিশাল পরিধি থেকেই তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে রোবটিকস নিয়ে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব একটা ভাবতে হবে না। স্নাতক শেষে তাদের রয়েছে দেশে অথবা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের বেশ চাহিদা আছে। এ ছাড়া দেশের মাটিতেও চাহিদা বাড়ছে। আমাদের বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে চতুর্থ বর্ষে পড়ছে। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান—যারা রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কন্ট্রোল সিস্টেম ডিজাইন, ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে—তারা এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশের সফটওয়্যার শিল্পেও কাজের সুযোগ থাকছে। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশে তাদের আরএনডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বিভাগ চালু করছে। যেখানে আমাদের শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে তারাও দক্ষ রোবটিকস জানা কর্মীর খোঁজ করে।
কাদের পড়া উচিত?
শুরুতেই বলছিলাম যে রোবটদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্রোগ্রাম দিয়ে। আর রোবট ডিজাইন ও রোবট প্রোগ্রামিংয়ের জন্য চাই গণিতে শক্ত ভিত ও গণিতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান তো থাকছেই। আগে থেকে প্রোগ্রামিং জানা না থাকলেও সমস্যা নেই। তবে কোর্স শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রোগ্রামিংয়ে অভ্যস্ত হতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ইলেকট্রনিকস শেখার আগ্রহ। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সৃজনশীলতা, যৌক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতা ও তত্ত্বীয় জ্ঞানকে ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার মানসিকতা। আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা আজকের জন্য তৈরি হয় না—বরং তারা স্বপ্ন দেখে আগামীর। তাই আজ কিছু শিখলে কাল আবার নতুন কিছু শেখার মানসিকতা থাকা জরুরি। গণিত, প্রোগ্রামিং আর ইলেকট্রনিকস নিয়ে লেগে থাকার মানসিকতা থাকলেই এই বিভাগে আসা ঠিক হবে বলে আমার পরামর্শ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন