স্পেলনডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন বা বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থায় খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।
ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। ১৯১৩ সালে ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ কর্তৃক নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং একই বছর ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদন। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩)১৯২০। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালে ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতি বছর “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস” হিসেবে পালন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১ জুলাই, ২০১৯। শতবর্ষের পথের যাত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯২১ সালে এই দিনে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ডিগ্রি ক্লাসে অধ্যায়নরত ছাত্রদের নিয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৮৫০ জন শিক্ষার্থী ও ৬০ জন শিক্ষক নিয়ে শুরু করেছিল শিক্ষা কার্যক্রম। দীর্ঘ এই সময় জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি একটি দেশের অভ্যুদয়, অভ্যুদয় পরবর্তী দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অবদান রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের নানা কর্মকাণ্ডসহ ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকার ফলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
এশিয়া তথা বিশ্বের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই ছিলেন এ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই পাঠদান করতেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন বসু, হরিদাস ভট্টাচার্য, জি এইচ ল্যাংলি, রাধা গোবিন্দ বসাক, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বিএম সেনগুপ্ত, গণেশচরণ বসু, রাজেন্দ্র চন্দ্র হাজরা, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জিসি দেব প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠার কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে যশ, খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেছে, বর্তমানে তার অনেকটাই হারাতে বসেছে। বিদ্যাচর্চা, গবেষণা ও পঠন-পাঠনের গতিধারাও কমে গেছে আগের তুলনায়। দলপ্রীতি-স্বজনপ্রীতির কাছে হার মেনেছে নীতি-নৈতিকতা। অর্থ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতা অধিগ্রহণের দিকেই বেশি ধাবিত কিছু শিক্ষক ও ছাত্রনেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে না। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কোন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা, বই প্রকাশ ছাড়া চলতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে আবাসিক জীবনযাপন, পড়ালেখার পরিবেশ, ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ এবং এর সঙ্গে শিক্ষার্থী নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। দেশ সেরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পর প্রথম বছরেই যখন মসজিদ, টিভি রুম কিংবা ফ্লোরে শিক্ষার্থীদের রাত কাটাতে হয় তখন সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু শিক্ষার্থীবান্ধব সেটা প্রশ্ন করার আবশ্যকতা থাকে না। হলগুলোর পরিবেশও আজ বড় অস্বাস্থ্যকর আর ঘিঞ্জি। চার বেডের এক রুমে থাকতে হয় ৮ জনকে। গণরুম বলে খ্যাত রুমগুলোতে সেই ৮ জনের বিপরীতে ফ্লোরিং করে থাকে অন্তত ৩০ জন। আর শিক্ষার্থীদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো। একটি সিটকে পুঁজি করে রাজনীতির হাতেখড়ি দেয়। যার মাশুল অনেককেই ভয়াবহ আকারে দিতে হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি সেশনে গড়ে প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ঘটনাও অহরহ। এছাড়া মেধার বিপরীতে দলীয় বিবেচনা, স্বজন প্রীতি ও তৃতীয় পক্ষের খবরদারিতে তুলনামূলক অযোগ্য ও কম মেধাবীদের নিয়োগ দিতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে এখানকার ফার্স্টক্লাস ফার্স্টধারী স্কলার প্রার্থীরা।
প্রফেসর এমিরেটস সিরাজুল ইসলাম বলেন, তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যা করেছে পৃথিবীর অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় তা করতে পারেনি। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছাত্র হিসেবে সর্বোচ্চ মেধাবীদের পাচ্ছি। তবে শিক্ষক নিয়োগে আমরা কতটুকু স্বচ্ছ, কতটুকু মেধাকে দিচ্ছি এটা দেখার বিষয়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলাদেশের কাছে আমরা দায়ী থাকবো বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, আর্থিকভাবে আমরা সরকারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেই এগিয়ে নিতে হবে।
তবে এ থেকে পরিত্রানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানালোকে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মহান ব্রত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতকের পথে এগিয়ে নেয়া। পূর্বের ন্যায় দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সব সময় পরিবর্তিত জীবনাদর্শ, বাস্তবতা, উদ্ভাবন ও বিবর্তন বিশ্লেষণ করে জাতিকে দিকনিদের্শনা দেয়ার উপযোগী করা এই বিদ্যাপীঠের প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে। জাতিকে উদারনৈতিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম উপহার দিতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাধর্মী কাজ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বিনির্মানে একটি যোগ্য ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এ বিশ্ববিদ্যালয় সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
যেভাবে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে চাই:
(১) গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: গবেষণাই হতে হবে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। উৎসাহ প্রদানের জন্য হলেও প্রতিটি জার্নালে আর্টিকেল পাবলিকেশনের জন্য গবেষকদের সম্মানির চালু যেমন- জার্নালভেদে এ প্লাস শ্রেণির জন্য ৫ লাখ; এ শ্রেণির জন্য ৪ লাখ; বি শ্রেণির জন্য ৩ লাখ; সি শ্রেণির জন্য ২ লাখ টাকা সম্মানীর ব্যবস্থা। এর ফলে শিক্ষকরা গবেষনা কার্যে অধিক মনোযোগী হতে পারবে।
(২) ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : একটি স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সকল কার্য সম্পাদন (আবাসিক হল বা ক্যাম্পাসে প্রবেশে/বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সেবা গ্রহণে/ ক্যাম্পাসে সকল ক্রয়সহ যাবতীয় কার্যে একটি কার্ড)।
(৩) ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা : ২৪/৭ এক্সেস থাকতে হবে, যখন খুশি একজন শিক্ষার্থী প্রবেশ এবং পড়াশুনা করতে পারবে। সকল বই এর অনলাইন/সপ্ট কপি সহজলভ্য হতে হবে।
(৪) ছাত্রদের পর্যাপ্ত আর্থিক সহয়তা/লোনের ব্যবস্থা করা : একজন শিক্ষার্থীও যাতে অর্থাভাবে ঝরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে বৃত্তি/স্টুডেন্ট লোনের ব্যবস্থা। ধরা যাক, ১০০০ হাজার ছাত্রের লোনের প্রয়োজন-৫০০০ টাকা করে হলে দরকার =৫০০০*১০০০=৫০ লক্ষ টাকা (মাসিক); বাৎসরিক ৬ কোটি টাকা লোন। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে মোট লোন হবে ৫০০০*১২*৫=৩ লক্ষ টাকা। এ লোন চাকরি প্রাপ্তির এক বছর পরেই কিস্তিতে শোধযোগ্য।
(৫) নিয়মিত এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা : নিয়মিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় /বিভাগের সহিত মতবিনিময়/সেমিনার/ সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থাকরণ।
(৬) স্নাতক পর্যায়ে মেজর ডিগ্রির পাশাপাশি একাধিক মাইনর ডিগ্রি প্রদান: বিশ্বের নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের ডিগ্রি প্রচলন থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে এটা সময়ের দাবী।
(৭) ক্যারিয়ার সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ইন্টার্ন ও জবের নিশ্চয়তা প্রদান, পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুালো তাদের গ্রাজুয়েটদের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে সহায়তা অব্যাহত রাখছে।
(৮) একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রস্তুত এবং মেনে চলা: একই সময়ে ক্লাস শুরু এবং একই সময় শেষ উদাহরণ স্বরূপ: ফল সেশন আগস্ট-ডিসেম্বর; স্পিরিং সেশন জানুয়ারি-মে।
(৯) মেধাবীদের মধ্য হতে নেতৃত্ব বাছাই: সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কমপক্ষে টপ ২০ মেধায় থাকতে হবে, তাহলে পড়াশুনা বিমুখ হবে না ।
(১০) ছাত্রদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, মোটিভেশন এবং এওয়ার্ড প্রথা চালুকরণ।
লেখক: অতিরিক্ত কমিশনার, কাস্টম হাউস, বেনাপোল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন