কিছু দিন আগেও বিভিন্ন পত্রিকা এবং টেলিভিশন টকশোগুলো শিশুদের অতিরিক্ত পড়ার বোঝা হ্রাসের বিষয়ে সরব ছিল। বলা হতো, অতিরিক্ত পড়ার চাপ শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করছে, শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি ইত্যাদি ইত্যাদি। ইদানিং এ বিষয়ে খুব একটা আলোচনা দেখছি না, হয়তো আমাদের শিশুরা কঠিন চাপের সাথে মানিয়ে নিয়েছে, নিজের শৈশবের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে।
অভিভাবকরাও মেনে নিয়েছেন এই ভেবে, ‘প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে না! আর তাছাড়া, ক্লাস ওয়ান থেকে এইচএসসি ও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে চান্স পেলেই তো মুক্তি! চাপ ফ্রি, অসম প্রতিযোগিতা ও অস্থিরতা মুক্ত এক পরিসরের হাতছানি!’। কিন্তু আসলেই কি তাই? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার সিস্টেমের কারণে প্রচন্ড ব্যস্ত সূচিতো আছেই পাশাপাশি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নানাবিধ অস্থিরতা; যার মধ্যে অতি অল্প বয়সেই চাকরি বা ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া অন্যতম। ওদের (অধিকাংশ) দেখলে মনে হয় যেন বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করছে!
যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিসরেও ওরা বন্দি। এর কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি বেশ কিছু দিন ধরে।
১. কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আড্ডায় শিক্ষক, বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংকার সবাই ছিলেন। আড্ডার একসময় দুটি ছেলে আসলো, ডিপার্টমেন্টের খুব জুনিয়র হওয়ায় আমি চিনি না। ওরা বিসিএস ক্যাডার কিভাবে হবে পরামর্শ নিচ্ছিল। আমাদের মধ্যে থেকে একজনের (বিসিএস ক্যাডার) পরামর্শ ছিল এমন: .. এই এই বই কিনো, দিনে ১৬ ঘন্ট পড়বা কমপক্ষে, ক্লাস-টাস করে তেমন কিচ্ছু হয় না, লাইব্রেরিতে সময় দাও.. বিভিন্ন সংগঠন-ফংগঠন দরকার নাই, বিসিএস ধ্যান-জ্ঞান কর,...ইত্যাদি। ওরা পরামর্শ নিয়ে চলে গেলে আমি জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম মাত্র অনার্স ১ম সেমিস্টার ফাইনাল শেষ করলো ওরা!
২. আমার কাছেও অনেকে পরামর্শ নেয় (ফোনে, ফেইসবুকে বা সরাসরি)। তবে, ইদানিং দেখছি খুব নবীন ছেলে-মেয়েরাও খুব চিন্তাক্লিষ্ট মুখ নিয়ে বলছে, বলছে: স্যার খুব টেনশনে আছি! একাডেমিক পরামর্শের চেয়েও বেশি চায় কিভাবে চাকরিতে ভালো করা যাবে! কী কী বই পড়বে এর জন্য? খারাপ লাগে যখন দেখি এদের অনেকেই ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়ার এর। কারন জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, অমুক, তমুক নাকি বলেছেন সব ছেড়ে দিয়ে এখন থেকেই আদা-জল খেয়ে শুরু করতে হবে।
৩. ফেইসবুকও অনেকটাই এর জন্য দায়ী বলে আমার মনে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা দিতে না দিতেই সিনিয়রদের সাফল্যের সংবাদগুলো দেখে দেখে অনেকেরই মাথা বিগড়ে যায়, ধারাবাহিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়কে ছাপিয়ে সাফল্যের মোহ তাড়িয়ে বেড়ায় এই সদ্য কৈশোর উত্তির্ণ ছেলে-মেয়েগুলোর। সব ছেড়ে ছুটে বেড়ায় সেই মোহের টানে, কেউ কেউ সঠিক পথে আর বেশিরভাগই এলোমেলো পথে। এক অসীম হতাশা ও আশংকা গ্রাস করে নেয় এদের।
এবার আসি বিশ্লেষণে, বিষয়টা আমার কাছে সময়ের আগেই ফল পাকানোর মত মনে হয়েছে। একটি ফল গাছে ধরে, নির্দিষ্ট সময়ের পর আকৃতি লাভ করে, সুগঠিত হয় এবং সঠিক সময়েই পরিপক্ক মিষ্টি ফলে পরিণত হয়। শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা ও দেখভাল করা। কিন্তু কেউ যদি মনে করে মাঝের এই সময়টুকু দরকার নাই, শর্টকাটে/হরমোন দিয়ে ফল পাঁকাবে! তাহলে কেমন ফল পাওয়া যাবে? অনুপ এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করার পর একটি ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে, তখন সে নিজেকে নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি ও নতুন একাডেমিক সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিবে।
একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের জ্ঞানের দূর্বলতা দূর করবে, শিল্প-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবে। এরপর একটি সময়ে তারা অনেকটাই পরিণত হবে, তখন অল্প কিছু দিন ক্যারিয়ার সম্পর্কিত লেখা-পড়া করলেই সাফল্য আসবে। এটাইতো সঠিক প্রক্রিয়া হবার কথা, তাই নয় কি? বাস্তবে আমরা দেখছি ঠিক উল্টোটি, কাঁচা বয়েসী ছেলে-মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হলোঃ সব বাদ, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত কিছু বই নিয়ে পড়ে থাকো!!
ক্যারিয়ার নিয়ে যারা পরামর্শ দেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ-
প্লিজ, অন্তত অনার্সের প্রথম দুটি বছর (৪টি সেমিস্টার) কারো মাথায় চাকরির পোকা ঢুকাবেন না। দিননা ওদের মত করে বেড়ে উঠার জন্য কিছু সময়। পারলে ওদের দূর্বলতা গুলো ধরিয়ে দিয়ে কিছু দিক নির্দেশনা দিন, সুস্থ্য সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যের পথ দেখান।
কিছু পরামর্শ-
অনার্স ১ম থেকে ৩য় বর্ষে পড়ছেন যাঁরা তাঁরা ক্যারিয়ার সম্পর্কিত পরামর্শ চাইতে আসলে আমি এই পরামর্শগুলো দিয়ে থাকি (আপনাদের কাজে লাগতে পারে)-
ক) মন প্রাণ ঢেলে তোমার যে সাবজেক্ট অর্থ্যাৎ একাডেমিক পড়াশোনা করবে,
খ) নিজের দূর্বলতাগুলো চিহ্নিত কর যেমন- কারো ভাষাগত সমস্যা যেমন- ইংরেজি ও বাংলা শুদ্ধ করে বলা ও লিখা, সাধারণ গণিতের বেসিকে সমস্যা, কারো জনসম্মুখে কথা বলতে সমস্যা ইত্যাদি,
গ) তোমার সমস্যা সমাধানের জন্য দুই/তিন বছরই যথেষ্ঠ, এই সময়টুকুতে আবৃত্তি, নাটক, বিতর্ক চর্চার সাথে যুক্ত থাকো,
ঘ) আশে-পাশের বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখো, বুঝতে চেষ্টা কর, পত্রিকা (ইংরেজী ও বাংলা) পড় দিনে অন্তত দুটি, ঙ) বেশি বেশি গল্পের বই পড়, গান শোন, মুভি দেখো আর আড্ডা দাও,
চ) রুটিন মেনে চলা, দিনে কমপক্ষে এতো ঘন্টা পড়া এগুলো না করলেও হবে, জাষ্ট নিজের দৈনন্দিন জ্ঞানের চাহিদা পূরণ (একাডেমিক+সেল্ফ ডেভোলাপমেন্ট+ রিক্রিয়েশন) হলেই হবে,
ছ) আর যাঁরা তোমাকে গুটিকয়েক বই এর নাম বলে, সব ছেড়ে দিয়ে ১৬ ঘন্টা পড়তে বলবে তাদের থেকে অবশ্যই ১০০ হাত দুরে থাকবে।
৪র্থ বর্ষ ও মাস্টার্স এ পড়ছেন যারা, তাঁদের জন্য
ক) এখনই সঠিক সময় নিজেদের একাডেমিক পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ক্যারিয়ার সংক্রান্ত পড়া শুরু করার,
খ) পাশাপাশি উপরের পরামর্শগুলোও কাজে লাগতে পারে।
আমি যেহেতু বিসিএস ক্যাডার না, সুতরাং কেউ বিসিএস সংক্রান্ত পরামর্শ চাইলে আমি এমন একজন ব্যক্তি নাম বলি যিনি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁকে অনুসরণ করতে বলি, তাঁর নির্দেশনা মেনে চলতে বলি। আমি নিশ্চিত করি যেন তিনিও জীবনবোধ, জীবনগঠন ও ক্যারিয়ার এই ৩টি বিষয়ের সমন্বয় করেই সব পরামর্শগুলো প্রদান করেন। ফলে একজন ছাত্র/ছাত্রী নিজেকে বিকশিত করার পথ খুঁজে পান, জীবনকে গঠন ও সুন্দরভাবে উপভোগ করার মাধ্যমে ক্যারিয়ারেও সফল হতে পারেন।
স্বপ্ন দেখুন বড়, তবে বড় স্বপ্ন পূরণের জন্য ভিতটাও সুদৃঢ় হতে হয়, সময় দিতে হয়, শ্রম দিতে হয়। শর্টকাট বা এলোপাথাড়ি ছুটে চলার ফলাফল বেশিরভাগ সময়ই তিক্ত হয়।
(বিঃদ্রঃ এই লেখার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা পেশাকে অসম্মান বা হেয় করার চেষ্টা করা হয় নি। বিসিএস শব্দটি কথা ও উদাহরণে বার বার এসেছে সঙ্গত কারণেই।)
মুহাঃ শহীদুল হক: প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন