এক যুগ আগেও ‘ভাইরাল’ শব্দটি ছিল আতঙ্কের কারণ। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ভাইরালকে দিয়েছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি। অনেকেই এখন ভাইরাল হতে চান। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভাইরাল হওয়ার জন্য খোঁজে নানা উপায়। মুদ্রার উল্টো দিকও আছে; অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার কারণে অনেকের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ, ছড়ায় ভুল তথ্য। ভাইরালের ভালো–মন্দ নিয়ে লিখেছেন মাহফুজ রহমান।
কোনো ছবি, ভিডিও বা লেখা অনলাইনে হড়কা বানের মতো প্রচণ্ড গতিতে বয়ে গেলে আমরা সেটাকে বলি ভাইরাল। এই ছবি, ভিডিও বা লেখাগুলো অনেক সময় বানের তোড়ে ভেসে যায়। কোনো কোনোটি স্রোত থেকে বেরিয়ে স্থায়ী আসন গাড়ে। এর কোনো কোনোটি সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কিছু ভাইরাল বিষয় স্রেফ আনন্দ দিয়ে যায়, কোনোটি ভাবায় কিংবা কাঁদায়।
ভাইরাল কবে থেকে ভাইরাল হলো? যবে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনপ্রিয় হলো—সাধারণ উত্তরটি সবারই জানা। ভাইরাল তো আদতে ইন্টারনেটেরই সন্তান। তবে ইন্টারনেট যখন আসেনি, কিংবা তারও আগের অনেক কিছুই তো ভাইরাল হয়েছিল। একটু অন্যভাবে চিন্তা করা যাক। খনার বচনের কথাই ধরুন। লিখিত কোনো রূপ ছিল না, কিন্তু আজও মানুষ খনার বচন মুখস্থ আওড়ায় গড়গড় করে। কারণ, খনার বচনও এক অর্থে অ্যানালগ ভাইরাল হয়েছিল। তখন মাধ্যম বলতে ছিল কেবল ব্যক্তির মুখ। বিদুষী খনা ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। সেগুলো ফলেও যেত হাতেনাতে। মানুষের বিস্ময়ের সীমা থাকত না। একজন আরেকজনকে খনার বচনের কথা বলত আগ্রহ নিয়ে। এভাবেই খনার বচন টিকে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আধুনিক জমানার কোনো বিষয় ভাইরাল হয় কী করে? কিংবা কী করে ভাইরাল হওয়া যায়? এর উত্তর কিন্তু খনার বচনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি।
অনলাইনের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ভাইরাল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন লেখক সেথ গোডিন। ২০০০ সালের ৩১ জুলাই ‘আনলিশ ইয়োর আইডিয়াভাইরাস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ফাস্ট কোম্পানি ডটকমে। সেখানে বলেছিলেন, ‘হ্যাভ দ্য আইডিয়া বিহাইন্ড ইয়োর অনলাইন এক্সপেরিয়েন্স গো ভাইরাল…’। প্রবন্ধটির কী হয়েছিল জানা নেই, তবে ভাইরাল শব্দটি পরে ঠিকই ভাইরাল হয়ে গেছে।
ভাইরালের শুরু ‘বাজে দিনে’
১৯৯৭ সালের ভিডিওটি অনেকেই দেখে থাকবেন। ভিডিওটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় ধারণ করা। বিশাল বপু ও গোঁফওয়ালা এক মার্কিন চাকুরে ঢাউস সিআরটি মনিটরের সামনে বসে কাজ করছেন। কি–বোর্ডে রীতিমতো ঝড় তুলেও সুবিধা করতে পারছেন না। ‘কমান্ড’ কাজ করছে না বলে একসময় রাগে–ক্ষোভে কি–বোর্ড তুলে নিলেন হাতে। আঘাত করলেন মনিটরে। টেবিল থেকে মনিটর পরে যাওয়ার পরও রাগ কমল না তাঁর। পাশের ডেস্কের সহকর্মী মাথা উঁচিয়ে বিষয়টি আঁচ করার চেষ্টা করলেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা কর্মী লাথি মেরে বসলেন মনিটরে। ২৫ সেকেন্ডের এই ‘ব্যাড ডে’–ই প্রথম ভাইরাল ভিডিও হিসেবে স্বীকৃত। ভিডিওটি ছড়িয়েছিল ই–মেইলে। বুঝতেই পারছেন, ফেসবুক, ইউটিউবের তখনো জন্ম হয়নি।
ভিডিওটি যে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে, তা এক বছর বাদে টের পান ওই খ্যাপা চাকুরে। তাঁর নাম ভিনি লিচিআরডি। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের লোরোনিক্স ইনফরমেশন সিস্টেমস নামের এক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শিপিং ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ভিডিওটি দাবানলের মতো ছড়াতে ছড়াতে সিএনএন, এনবিসি টিভি থেকে শুরু করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো সংবাদমাধ্যমের ‘হট টপিক’ হয়ে ওঠে।
মজার ব্যাপার হলো, ভিডিওটি ছিল সাজানো। ১৯৯৭ সালে ডিজিটাল ভিডিও–নিরাপত্তাব্যবস্থা বাজারে এনেছিল লোরোনিক্স ইনফরমেশন সিস্টেমস। মানুষকে এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতেই ভিডিওটি বানানো হয়েছিল। বানানোর পর সিডিতে করে বিলি করা হয় নানান জায়গায়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে ই–মেইলের মাধ্যমে। বাকিটা ইতিহাস!
কাইলির চেয়ে ডিম এগিয়ে
‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ বলে চিরকালীন এক বিতর্কের বিষয় আছে। তবে মার্কিন মডেল কাইলি জেনারের চেয়ে ইন্টারনেটের এক ডিম যে যোজন যোজন এগিয়ে আছে, তা এখন পরিষ্কার। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এ বছরের ৪ জানুয়ারিতে ইনস্টাগ্রামে@world_record_egg নামের অ্যাকাউন্টে একটি ডিমের ছবি আপলোড করা হয়। ক্যাপশনে বলা ছিল, ‘আসুন, ইনস্টাগ্রামে সবচেয়ে বেশি লাইকের পোস্ট বানিয়ে সবাই মিলে একটি বিশ্ব রেকর্ড গড়ি। বর্তমান বিশ্ব রেকর্ডধারী কাইলি জেনারকে (১৮ মিলিয়ন) হারিয়ে দিই।’ সত্যি সত্যিই দিন দশেকের মধ্যে কাইলির সন্তান স্টর্মির ছবিটি পেছনে ফেলে এক নম্বরে চলে যায় ‘ইন্টারনেট এগ’! এই ডিমের ছবিটি এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটের যাবতীয় পোস্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া পোস্ট। গতকাল পর্যন্ত এর লাইকসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৩৮ লাখ ১৪ হাজার ২১৬!
কে ‘পেড়েছিল’ এই ডিম? অনেকেই দাবি করেছিল, আমি এই পোস্টের মালিক। অবশেষে গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট হুলু এবং নিউইয়র্ক টাইমস খোলাসা করে সব। ডিমের আসল মালিক ব্রিটিশ নাগরিক ক্রিস গডফ্রে। বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী ক্রিসের এই কীর্তির সঙ্গী ছিলেন তাঁর দুই সহকর্মী অ্যালিসা খান–হেলান ও সি জে ব্রাউন। ‘ইন্টারনেট এগ’ এখন বিখ্যাত। ডিমটিকে হুলুর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক বিজ্ঞাপনেও দেখা গেছে। ডিমের এই ছবি কাইলি জেনারের গাত্রদাহের কারণও হয়েছে! মজার ব্যাপার হলো, ছবিটি তুলেছিলেন সের্গেই প্লাতানভ নামের অখ্যাত এক আলোকচিত্রী। ২০১৫ সালের ২৩ জুন সেটি পোস্ট করেছিলেন শাটারস্টক নামের ওয়েবসাইটে। এটা নিশ্চিত, প্লাতানভ কল্পনাও করেননি তাঁর ডিমের ছবি এমন রেকর্ড করে বসবে। ইন্টারনেটে এমন আরও হাজারো ভাইরাল ছবি আছে। ভাইরাল ছবির সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। এবং এগুলোর মধ্যে কোনটি যে সবচেয়ে এগিয়ে, তা বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল! লেখা বা খবরের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।
ভাইরালের ভালো–মন্দ
কেবল কি ভাইরাল? ইন্টারনেট, এমনকি মানবজীবনও তো ভালো–মন্দের মিশেল। এক ভাইরাল ভিডিওর কল্যাণে যেমন উগান্ডার কুখ্যাত অপরাধী জোসেফ কোনিকে চিনেছিল বিশ্ব। ২০১২ সালে কোনি ২০১২ নামের এক প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেন মার্কিন নির্মাতা জেসন রাসেল। এর প্রধান চরিত্র ছিল জ্যাকব, যার বড় ভাইকে মেরে ফেলে লর্ড’স রেজিস্ট্যান্স আর্মির (এলআরএ) নেতা জোসেফ কোনি। কেবল জ্যাকবের ভাইকে নয়, কোনি এমন হাজারো শিশু–কিশোরকে মেরে ফেলে। হাজারো শিশু–কিশোরকে ভেড়ায় বিদ্রোহী দল এলআরএতে। চালায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কায়েম করে সন্ত্রাসের রাজত্ব। মেয়ে শিশুদের ওপর চালায় যৌন নির্যাতন। সন্তানদের দিয়ে হত্যা করে অসংখ্য মা–বাবাকে। ভাই হারানো জ্যাকবের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই কোনির বিচারের আশায় তথ্যচিত্র নির্মাণে হাত দেন রাসেল। অবশেষে ২০১২ সালে ওই ভিডিও ভাইরাল হলে মার্কিন কর্তারাও নড়েচড়ে বসেন। উগান্ডায় বিশেষ বাহিনীও পাঠান কোনিকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতার জন্য। ইউটিউবে সে সময় কোনি ২০১২ ছিল সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও। টাইম ম্যাগাজিনের বিবেচনায়ও সবচেয়ে ভাইরাল ভিডিও হিসেবে উঠে আসে কোনি ২০১২–এর নাম। এক জরিপে দেখা যায়, ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক তরুণ কোনি সম্পর্কে জানতে পারে। শেষমেশ জোসেফ কোনি অবশ্য অধরাই থেকে যায়। তবে তার বাহিনী বিলুপ্তির পথে। এবং উগান্ডার শিশু–কিশোরেরা এখন শঙ্কামুক্ত।
মুদ্রার উল্টো পিঠে আছে ভাইরালের মন্দ দিক। নেতিবাচক এমন হাজারো ছবি, ভিডিও বা লেখা আছে ইন্টারনেটে। অনলাইনে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই এর অন্যতম সমাধান। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভাইরাল মানেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেহেতু কোনো সম্পাদক নেই, যা ইচ্ছা তা–ই শেয়ার করা যায়। অতএব নিশ্চিত না হলে যাচাই করে নেওয়াই উত্তম।
পোস্ট ভাইরাল করতে চান?
ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভাইরাল শব্দটি বেশ পয়মন্ত। কে না জানেন, প্রচারেই প্রসার। ফোর্বস ও আপওয়ার্কের দুটি লেখায় ভাইরাল পোস্টের কিছু সূত্র তুলে ধরা হয়েছে। দুটিতেই দেওয়া হয়েছে নিচের আট পরামর্শ। মজার ব্যাপার হলো, শুরুতেই যা বলছিলাম, খনার বচনে এর প্রায় সব গুণই বিদ্যমান!
১. ইতিবাচকতা: ইতিবাচক বিষয় সবাইকে টানে। যেকোনো ভালো কাজের ছবি, লেখা, ভিডিও সবার কাছে সমাদৃত।
২. সম্পর্ক: পোস্টের বিষয় নিজের সঙ্গে মিলে গেলে মানুষ একাত্মবোধ করে। শেয়ার করতেও দ্বিধা করে না।
৩. আবেগ: মানুষ যে বিষয় যত বেশি ভালোবাসে, সেটি শেয়ারও করে ততটাই। যেমন: মা, শিশু, বৃদ্ধ, আদুরে প্রাণী—সবাই ভালোবাসে।
৪. সময়: কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপরই পোস্ট আপলোড করা হলে ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সময় গেলে সাধন হয় না।
৫. গল্প: মানুষ দিন শেষে গল্পই শুনতে চায়। সেটি লেখা, ছবি বা ভিডিও যে মাধ্যমেই হোক না কেন।
৬. প্রয়োজন: মানুষ যখন দেখে একটি খবর কাছের মানুষকে জানালে উপকার হবে, তখনই তা শেয়ার করে।
৭. বৈশ্বিক উপাদান: আমাজনের আগুন নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ উদ্বিগ্ন ছিল। ফলে এ–সংক্রান্ত পোস্ট শেয়ারও হয়েছে ব্যাপক।
৮. ব্যক্তির লাভ: মানুষ নিজেকে সুন্দর দেখাতে চায়। এমনকি নিজের বিড়ালটিকেও যেন সুন্দর লাগে, সেটিও খেয়াল করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন