ব্যাংক হিসাব রয়েছে—দেশের এমন মানুষের বেশির ভাগই মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এ হার প্রায় ৩৯ শতাংশ। আর ২৪ শতাংশ ব্যাংক হিসাবধারীর পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য তথ্যও রয়েছে। ২১ শতাংশ ব্যাংক হিসাবধারী পড়াশোনাই করেননি। এ ছাড়া একটি করে ব্যাংক হিসাব রয়েছে ৭৬ শতাংশ হিসাবধারীর। আর দুটি করে হিসাব রয়েছে ১৭ শতাংশের এবং দুটির বেশি হিসাব রয়েছে ৭ শতাংশের।
অর্থায়নের সুযোগের প্রভাব বিশ্লেষণ বিষয়ে গত জুলাইয়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। জরিপে ৮ বিভাগের ৮ জেলার ৪টি করে ইউনিয়নের ২ হাজার ৮৭২ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে ছয় সদস্যের একটি দল এই জরিপ করে।
জরিপের তথ্যে আরও উঠে এসেছে, ব্যাংকে হিসাব থাকা ব্যক্তিদের ৩৮ শতাংশের বয়স ৬ থেকে ৩০ বছর। অর্থাৎ তরুণদের ব্যাংক হিসাবই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ২৪ শতাংশ হিসাব রয়েছে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের, ২০ শতাংশ হিসাব ৫১ বছরের বেশি বয়সীদের, ১৮ শতাংশ ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের। এ ছাড়া ৬২ শতাংশ হিসাবধারী পুরুষ ও ৩৮ শতাংশ হিসাবধারী নারী।
জরিপে উঠে এসেছে, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা জানা ব্যক্তিদের হিসাব ১০ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব মাত্র ৬ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে ২২ শতাংশই ব্যবসায়ী, আর ছাত্র ১৪ শতাংশ ও চাকরিজীবী ৮ শতাংশ।
জরিপকারী দলের একজন সদস্য জানান, সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময় কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন অনেক কৃষক হিসাব খোলেন। জরিপে তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পাস এবং অশিক্ষিতদের মধ্যে ৭০ শতাংশই হবে এই ১০ টাকার ব্যাংক হিসাবধারী।
জরিপের ফলাফল বলছে, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ব্যাংকের শাখা ছিল ১০ হাজার ১১৪টি। ২০০০ সালের তুলনায় তা ৬৫ শতাংশ বেশি। তবে একই সময়ে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকের শাখা কমেছে। ২০০০ সালে গ্রামাঞ্চলে শাখা ছিল ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ১০ টাকায় কৃষকদের জন্য হিসাব খোলার সুযোগ তৈরির ফলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। লেখাপড়া না জানা কিংবা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা জানা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব এ কারণেই বেশি। গ্রামাঞ্চলে শাখা কমে যাওয়ার বিষয়ে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘শাখা খুলতে পয়সা লাগে, বরং গ্রামীণ ব্যাংক মডেলে কম খরচে ব্যাংকিং সেবা চালু করলে অর্থায়নের সুযোগ বাড়বে।’
বাংলাদেশে আর্থিক খাতে টাকা আসে মূলত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৬ ব্যাংক, বিশেষায়িত ৩ ব্যাংক, বেসরকারি ৪০ ব্যাংক ও বিদেশি ৯ ব্যাংকের মাধ্যমে। এ ছাড়া রয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম), বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিমা কোম্পানি ও সমবায় সমিতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ বলছে, বিভিন্ন দেশ থেকে যে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) আসে, তার মধ্যে নিজের ব্যাংক হিসাবে আসে ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ অন্য মাধ্যমে আসে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এমএফএসের মাধ্যমে আসে ১৯ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকের শাখা বাড়লেও এখনো দেশের মানুষদের বড় অংশ ব্যাংক সেবার বাইরে রয়েছেন। ব্যাংকের এক শাখা থেকে আরেক শাখার অধিক দূরত্বই এর অন্যতম কারণ। উদাহরণ টেনে বলা হয়, স্পেনে ১ লাখ লোকের জন্য ৯৬ শাখা এবং ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে ৭৯০টি শাখা রয়েছে। আর বাংলাদেশে ১ লাখ লোকের জন্য ৭টি শাখা এবং ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে ৬৭টি শাখা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য বাংলাদেশের মতো অত মাশুল গুনতে হয় না এবং প্রথমবার অত টাকাও জমা রাখতে হয় না। অথচ বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম, এমনকি বড় একটি অংশ দরিদ্র। ব্যাংক হিসাব খুলতে অনেক তথ্য-উপাত্ত লাগে বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। অথচ আলবেনিয়া, স্পেন, সুইডেন—এসব দেশে হিসাব খুলতে লাগে একটি তথ্য।
জরিপের তত্ত্বাবধানকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে চেষ্টা গত ৮ থেকে ১০ বছরে করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, অর্থায়নসংক্রান্ত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের বিচরণ বাড়ছে।প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন