সমসাময়িক শিল্পে বিমূর্ত শিল্পধারার আবির্ভাব চর্চার ধারাবাহিকতারই ফল। আজকের দিনে সব ধরনের শিল্পেই বিমুর্তায়ন একটি অতিস্বাভাবিক ঘটনা, কারণ শিল্প হলে শিল্পীর নিজস্ব প্রত্যক্ষণ ও ভাবনার ফসল। একটি বিশেষ মুহুর্তে কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করার পর স্মৃতি থেকে তাকে পুনরুদ্ধার করতে গেলে কিছু কিছু বিষয় হারিয়ে যায় আর সেই হারানো বিষয়গুলোই বিমুর্তরূপে এসে হাজির হয়।
শিল্পী মনসুর কাযী শিল্পী চর্চা যেন সেই রকম করে ক্যানভাস রচনা। প্রবাসী এই শিল্পী ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চলে যান মাসকটে। সেখানে ডিজাইন ফার্ম করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালেও পাশাপাশি শিল্পী চর্চায় নিজেকে নিবদ্ধ রেখেছেন বরাবর। চট্টগ্রামের রাউজানে বেড়ে উঠা এই প্রবাসী শিল্পী মনসুর কাযী নাড়ীর টানে মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে আসেন এবং প্রদর্শনীরও আয়োজন করে থাকেন। সম্প্রতি শিল্পী মনসুর কাজী চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমী প্রদর্শন করে গেলেন অর্ধশতাধিক শিল্পকর্ম নিয়ে দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনী। উক্ত প্রদশর্¬নী শিল্পী কর্মের বিষয় ছিল মানুষের অবয়ব, আবেগ, স্মৃতি, স্বপ্ন উক্ত বিষয়গুলো প্রধানত জ্যামিতিক ফর্মে বস্তুর আদল এবং প্রশমিত আভায় রঙের সীমিত ব্যবহারের মাধ্যমে আলোছায়া নির্মাণ করে দ্বিমাত্রিক উপরিতলে ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে আপ্রাণ চেষ্টা। ফলে আমরা দেখি শিল্পী মনসুর কাযীর শিল্পকর্মে মনুষ্য আত্মার উন্নয়ন ও পরিশীলন ঘটানো একটা ক্ষমতা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে বিমূর্তয়ানের ভিতর দিয়ে।
আবার অন্যদিকে তার বেশ কিছু শিল্পী কর্ম প্রকৃতি ও মানুষকে সঙ্গ করে সত্তা বা আত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন নিবিড়ভাবে অভিজ্ঞতা বিশ্বাস যুক্তি সংক্রান্ত বিষয় যেমন: অসীম, আদি ও অন্তহীনতার সাথে সত্ত্বার যোগসূত্র এবং মরমী সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি। বলা যায় শিল্পী মনসুর কাযী বিমূর্তায়নের একজন পুরোগামী শিল্পী। সীমিত রং অর্থাৎ কালো, লাল, গাঢ় নীল রং ব্যবহার করে শিল্পী যৌক্তিক পথে বস্তুগত উপাদানের ধ্বংসাবশেষ চিত্র রচনা করেছেন নানা অংশ ভেঙ্গে এবং ক্যানভাসে গঠনমূলক সাজিয়ে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় আমেরিকার বিখ্যাত বিমূর্ত প্রকাশবাদী শিল্পী জ্যাকসন পোলক এর কথা-শুধুমাত্র সমসাময়িক যুগের লক্ষ্যকে প্রকার করা ছাড়া আধুনিক শিল্পের আর কোন লক্ষ্য নেই। তবে পোলক নিজেকে সব ধরনের প্রচলিত রীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলেন। আর তেমনি শিল্পী মনসুর কাযী ক্যানভাসে রং ছিটিয়েছেন সম্পূর্ণ অবচেতন মনে এবং সৃষ্টির মুহুর্তে তিন পরিপূর্ণ রূপে তার মাঝে উপস্থিত থাকতে চাইতেন। তার বিশ্বাস ছিল যে রঙের প্রধান উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীন প্রয়োজনের নিখুঁত প্রকাশ। আবার এক আলাপে শিল্পী মনসুর কাযী বলেন, স্বতঃস্ফুর্তভাবে রঙের বৈশিষ্ট্য আবিস্কার করেছি। কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয় নি। শিল্পী উল্লেখ করে বলেন। যে শরতের ছবি আঁকার জন্য কোন রং শরৎ ঋতুর সাথে মানানসই তা আবার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র এই ঋতু যে অনুভুতি জাগিয়ে তোলে তার প্রেরণতাইে রঙের ব্যবহার করা হয়। শিল্পীর ‘কেইভ উইথ ম্যান’ সিরিজে দেখি রঙের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বলিত ক্ষেতের ওপর সৃষ্ট আনুভূমিক গঠনে তিনি এমন কিছু প্রকাশ করতে চেয়েছেন যা আলোর উৎস বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অন্ধকার তুলে ধরেছেন। যেখানে এক ধরনের শীতল শূন্যতা বা অনিবার্য ধ্বংসের অনুভূতি প্রতিফলিত। সেই সাথে মানুষের মৌলিক আবেগ প্রকাশ পেয়েছে অভ্যন্তরীন আবেগকে যুক্ত করে।
বর্তমানে নিজস্ব পথ ভঙ্গি প্রকাশের আঙ্গিক বিষয়াবলি ও রং এবং রেখার কারুকার্য, গঠন বিভাজন বিস্তার সব খুঁজে পেয়েছেন। এখন শিল্পী মনসুর কাযী নিজের শিল্পী সীমানায় উজ্জ্বল। এখানে অগ্রসরমান ক্রমাগত সামনের দিকে যেখানে শিল্পীর দক্ষতা ও অধ্যাবসায় দর্শককে ভাবাবে ও অনুভব করতে শেখাবে। যে শিল্পী অনুভুতিশীল নয়, দেখার ১০ সেকেন্ডের মধ্যে যে কোনোরূপ বার্তা দেয় না, তা আসলে স্বার্থক শিল্প নয়। বিমূর্ত শিল্পের সেই বৈশিষ্ট্য নেই তা নয়, তবে এই নামের ওপর ভর করে এমন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে যা শিল্পী পদবাচ্য নয়।
আমাদের সার্বিক শিল্প জগতে শিল্পী মনসুর কাযী অনন্য অবস্থান রেখে যাবে চর্চায় নিবদ্ধ থেকে। এই আশা নিশ্চয় নিরর্থক নয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন