সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমাম হোসাইন নামে এক ছাত্র নিজ গ্রামের বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে 'আল-বিদা' শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। গণমাধ্যমে জানতে পারি তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রেমঘটিত কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। এটাই তার আত্মহত্যার কারণ। মেয়ের বাবা তাকে পছন্দ করতেন না এবং প্রেমিকা তার সঙ্গে অতীতের মতো সম্পর্ক রাখতে চাইত না। এ কারণে তার মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। কিন্ত আমরা হারিয়েছি এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না।
এ ছাড়াও কিছুদিন আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী সুপ্রিয়া দাস আত্মহত্যা করেন। গণমাধ্যমে জানতে পারি কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তপুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওই শিক্ষার্থীর। কিছুদিন আগে তপু আত্মহত্যা করেছিলেন। তপুর আত্মহত্যার জন্য সুপ্রিয়াকে সামাজিকভাবে দোষারোপসহ নানান কটূক্তি করা হয়। সামাজিক ও মানসিক চাপেই সুপ্রিয়া আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বলে মনে করে তার নিকটতম বন্ধুরা। ঈদের দিন রাতে সন্ধ্যায় ফরিদপুরের নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। এ রকম ঘটনা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে, যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন এক শিক্ষার্থী। এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তিনি তাদের ব্যাচের প্রথম সারির ছাত্রী ছিলেন। এ ছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক ছাত্রী অনুষদ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে আত্মহত্যা করেছেন ২৩ বা তার বেশি ছাত্রছাত্রী। দেশের এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ কী, তা নিয়ে রয়েছে নানা ব্যাখ্যা ও মতামত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো প্রতিকার ব্যবস্থা নিয়েছে কি না জানি না। তবে বিষণ্ণতা, ভালো ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ, সহপাঠীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, পিতা-মাতার সঙ্গে অভিমান, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি কারণে তারা আত্মহননের পথ গ্রহণ করে বলে মনে করছেন অনেকেই।
নানা কারণে চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দপ্তর রয়েছে। 'ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শ দপ্তর' নামের এই দপ্তরে স্থায়ী কাউন্সেলর বা পরামর্শদাতা রয়েছেন মাত্র একজন। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নেই বললেই চলে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুসারে প্রত্যেক বিভাগে একজন করে মনোবিজ্ঞানী থাকা উচিত। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য একজন ছাত্র উপদেষ্টা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আবার যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, এর পেছনের কারণ কী, তা উদঘাটন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পরামর্শ দপ্তরও এ বিষয়ে কোনো তথ্য সংবরণ করে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার পরামর্শ দপ্তর সম্পর্কে অনেক শিক্ষার্থীর ধারণা নেই যে, এই দপ্তর তাদের জন্য কী করতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ দপ্তরে স্থায়ী পরামর্শকের পদ আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন আমাদের অনেক সহকর্মী।
আবার অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যাওয়ার প্রবণতা কম লক্ষ্য করা যায়। তবে কিছু শিক্ষার্থী পরীক্ষাভীতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা- এসব সমস্যা নিয়ে মাঝে মধ্যে শিক্ষকদের কাছে আসে। শিক্ষকদেরও দায়িত্ব রয়েছে, তারা যেন পাঠদান কক্ষে এবং অন্যান্য সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও জীবন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিকনির্দেশনা দেন; যা তাদের হতাশা কমাতে সহযোগিতা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিক পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের সংকটে সহযোগিতা ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রচার, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা পর্যালোচনা, স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা এবং অনুষদ বা বিভাগভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। বিশেষ আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তার বিষয়ে জোর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সেন্টার বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনাগত সমস্যা এবং বিভিন্ন মানসিক-স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর সচিত্র তথ্যযুক্ত লিফলেট ইস্যু করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে তা প্রচার করা যেতে পারে। এটা সাধারণ শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নানা সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করার কৌশল সম্পর্কে জানাতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারবে। অনুরূপ পদক্ষেপগুলো সক্রিয়করণের দিকে বিভাগের শিক্ষকদেরও নজর দিতে হবে। শিক্ষাগত অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফেনোটাইপ, যেখানে জ্ঞানীয় কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকে মানসিক অসুস্থতা। এ ছাড়া শিক্ষাগত ব্যর্থতার একটি মূল বৈশিষ্ট্য মানসিক অসুখ।
আমি মনে করি, এই সমস্যা সমাধানে বিশ্নেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে একটি সম্মিলিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; যার আলোকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টারগুলো পরিচালিত হবে। এ বিষয়ে জরুরি কোনো উপায় বের করা সময়ের দাবি। আর না হলে তা আমাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা হবে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী অকালে চলে যাবে। পিতা-মাতা হারাবেন তাদের স্বপ্ন ও অমূল্য সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠান হারাবে তার মেধাবী শিক্ষার্থী। এসব সমস্যা সমাধানে শুধু গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করলে হবে না বরং নতুনভাবে প্রশাসনকে চিন্তা করতে হবে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে যথার্থ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আমাদের বাংলাদেশে কোনো ছাত্রছাত্রী অকালে পৃথিবী থেকে চলে যাক এটা আমরা কেউ চাই না। শিক্ষার্থীরা একে অপরের সহযোগী কিংবা সহযোদ্ধা হিসেবে দেশকে গড়ে তুলবে এবং সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করবে- এটাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
shafiquejkkniu@gmail.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন