বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ১৮ মার্চ থেকে আলোক শিক্ষালয়ও বন্ধ হয়। এই শিক্ষালয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। ২০০৪ সালে অধ্যাপক রাশেদা নাসরীন ও তাঁর ক’জন সহযোগী ‘আলোক শিক্ষালয়’ প্রতিষ্ঠা করে বিনা বেতনে স্থানীয় বস্তিবাসীদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন। শিক্ষক শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লে স্কুলটি আর অবৈতনিক রাখা সম্ভব হয় না।
২০১৫ সাল থেকে নামমাত্র কিছু বেতন নেওয়া শুরু হয়। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্যে বৃহস্পতিবারের কার্যক্রমে নাচ, গান, বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন, কবিতা ইত্যাদি বিষয়ে ক্লাস হয়। এছাড়া বার্ষিক বনভোজন, শিক্ষাসফর, বিজ্ঞানমেলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, জাতীয় দিবসগুলো পালন তো আছেই। আরো আছে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিতরণের আয়োজন। এসবের মধ্য দিয়ে শিশুদের আনন্দমুখর করে রাখা হয়। শিশুদের কাছে আরো একটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল প্রতিদিন ঘরে তৈরি পুষ্টিকর টিফিন খাওয়া।
কিন্তু করোনা ভাইরাসে শিক্ষার্থীদের সেই আনন্দ হঠাত্ করে হারিয়ে যায়। তবে কেবল একটি মাস বন্ধ থাকার পর আলোকের পরিচালক রাশেদা নাসরীন আপা দূর-শিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করবেন বলে শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কারণ অনলাইনে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের বেশিরভাগের বাসায় স্মার্টফোন নেই, নেই ইন্টারনেট সংযোগ।
দূর-শিক্ষণের জন্য প্রথমেই সব শিক্ষককে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুত করে মেসেঞ্জারে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়, সেখানে নিয়মিত পরিচালক আপার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সেখানে দূর-শিক্ষণ কর্মসূচির জন্যে একটি দৈনন্দিন কর্মতালিকা তৈরি করে সেটি পালন করা শিক্ষকদের জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়। আলোকের মোট ১৮ জন শিক্ষক এই গ্রুপের মাধ্যমে কাজ শুরু করেন।
একটি সুবিধা ছিল, সব শিক্ষার্থীর ফোন নম্বর ছিল, যেখানে শিক্ষকেরা খুব কষ্ট করে হলেও যোগাযোগ করতে পেরেছেন। আনন্দের ব্যাপার হলো, এই কার্যক্রমে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে কিছু শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকদের আয়-রোজগার না থাকায় গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে। ভাবলে অবাক হই, ফোনের মাধ্যমে অনেকেই সেই গ্রাম থেকেও দূর-শিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে।
কর্মসূচি শুরু হয় ১১ মে ২০২০ থেকে। এতে রাখা হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। প্রথম ধাপ: শিক্ষকেরা প্রতি সপ্তাহে একটি অধ্যায় নির্বাচন করে সেই অধ্যায়ের ওপর শিক্ষার্থীদের ফোন করে পড়া দেওয়া, তারপর ঐ অধ্যায়ের ওপর মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা। প্রত্যেক শ্রেণিশিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দিতেন, সঙ্গে উত্তরপত্রও দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হতো। একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হতো লিখিতভাবে উত্তরপত্র তৈরির জন্য। শিক্ষার্থীরা বাসা থেকে লিখে স্কুলে তা নির্দিষ্ট সময়ে জমা দিয়ে যেত।
প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র দেওয়া-নেওয়ার জন্যে প্রধানশিক্ষক ও সহকারী প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে পালাক্রমে অন্য শিক্ষকেরাও স্কুলে দিনে দুই ঘণ্টা ও সপ্তাহে চার দিন অবস্থান করতেন। সেই অধ্যায়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষাও নেওয়া হতো, সঙ্গে এক পৃষ্ঠা হাতের লেখারও অভ্যাস করানো হতো। স্কুল থেকে প্রাথমিক শাখার সবাইকে হাতের লেখার খাতাও দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা হাতের লেখা শেষ করে খাতা জমা দেয়। শিক্ষকেরা সব খাতা মূল্যায়ন করে স্কুলে জমা দিলে পরিচালক আপা সেগুলো আবার নিরীক্ষণ করেন। এভাবে প্রতি মাসে প্রতিটি বিষয়ের ওপর একটি করে পর্বের কার্যক্রম চলেছে।
শিক্ষার্থীরা পরবর্তী পর্বের জন্য পড়া তৈরি করতে করতে শিক্ষকরা উত্তরপত্র ও হাতের লেখার মূল্যায়ন করেন। মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক শ্রেণিশিক্ষক তাঁর শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পরিচালক বরাবর জমা দেন। এভাবে এক একটি কর্মসূচিকে এক একটি পর্ব হিসেবে ধরা হয়। এই পর্বগুলোর প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে বার্ষিক মূল্যায়ন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করা হয়েছে নতুন শ্রেণিতে।
দূর-শিক্ষণের এই কার্যক্রমের জন্য শিক্ষকগণও কিছু সুবিধা পেয়েছেন। বেতন ৮০ ভাগ দেওয়া হলেও ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার এবং খাতা মূল্যায়নের জন্য সম্মানী পেয়েছেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের টিফিন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতি মাসে তাদের চাল, ডাল, তেল, নুন, সাবান ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে দেওয়া হয়েছে রান্না করা খাবার প্যাকেট করে বাড়িতে গিয়ে খাওয়ার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন